অনলাইন ডেস্ক:
প্রতিবেদন: নিউমোনিয়ায় বছরে ২৪ হাজার শিশুর মৃত্যু, নতুন টিকা ব্যবহারের পরামর্শ
বাংলাদেশে প্রতিবছর নিউমোনিয়ায় প্রায় ২৪ হাজার শিশু প্রাণ হারায়। শুধু শিশু নয়, বয়স্করাও এ রোগের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নিউমোনিয়া ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে—বিশেষ করে শীত মৌসুম ও ঋতু পরিবর্তনের সময় এই রোগের প্রকোপ বাড়ে।
শিশুদের মধ্যে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি
রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের নিউমোনিয়া ওয়ার্ডে গেলেই দেখা যায় ভয়াবহ চিত্র। কারও মুখে অক্সিজেন মাস্ক, কারও চলছে নেবুলাইজেশন, আবার কারও হাতে ক্যানোলা। বেশিরভাগই পাঁচ বছরের নিচের শিশু। অনেকের জন্মের পরের সময়টাই কেটেছে হাসপাতালে।
চিকিৎসকরা বলছেন, নিউমোনিয়া পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ, এবং এই বয়সের প্রায় ২৮ শতাংশ মৃত্যুই নিউমোনিয়ার কারণে ঘটে।
আইসিডিডিআর,বি-এর তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর ৭ লাখের বেশি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়।
ব্যাকটেরিয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে
চিকিৎসকদের মতে, নিউমোনিয়ার প্রধান কারণ বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ার ধরন বদলে যাচ্ছে, ফলে পুরনো টিকার কার্যকারিতা কমে গেছে।
২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়শা আক্তার জানান,
“এই রোগ প্রতিরোধে শিশুকালে এবং বয়স্কদের যে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়, তা বেশ কার্যকর ছিল। তবে এখন ব্যাকটেরিয়া পরিবর্তনের কারণে নতুন টিকা প্রয়োজন।”
নতুন প্রজন্মের টিকা ব্যবহারের পরামর্শ
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সারাবন তহুরা বলেন,
“পিসিভি (PCV) টিকা এখন অনেক জায়গায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে নতুন প্রজন্মের টিকাগুলোর কার্যকারিতা পর্যালোচনা করে আমাদের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচিতে (EPI) অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।”
চিকিৎসকরা মনে করেন, নতুন প্রজন্মের পিসিভি টিকা শিশুদের পাশাপাশি বয়স্কদের ক্ষেত্রেও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ছাড়া টিকাদান কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি ও সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।
ঝুঁকিতে বয়স্করাও
শুধু শিশুরাই নয়, ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক ব্যক্তিরাও নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে আছেন। বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ বা দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ ভয়াবহ আকার নিতে পারে।
ডা. আয়শা আক্তার বলেন,
“যাদের বছরে বারবার ঠান্ডা লাগে বা শ্বাসকষ্ট হয়, তাদের প্রতিরোধে বার্ষিক টিকা গ্রহণ অনেক উপকার করে।”
ঋতু পরিবর্তনে বাড়ছে সংক্রমণ
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ঋতু পরিবর্তনের সময়, বিশেষত শীতের শুরুতে নিউমোনিয়া আক্রান্তের হার দ্রুত বাড়ে। শিশুদের শ্বাসযন্ত্র ছোট হওয়ায় এবং রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তারা বেশি আক্রান্ত হয়।
তাই চিকিৎসকদের পরামর্শ,
- শিশুকে ঠান্ডা বাতাস বা ধুলাবালি থেকে দূরে রাখতে হবে,
- গরম পোশাক পরাতে হবে,
- পর্যাপ্ত পানি ও পুষ্টিকর খাবার দিতে হবে,
- এবং সঠিক সময়ে টিকা নিশ্চিত করতে হবে।
সচেতনতার অভাবই প্রধান বাধা
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অজ্ঞতা ও অবহেলার কারণে অনেক বাবা-মা সন্তানদের টিকা দিচ্ছেন না। ফলে প্রতিরোধযোগ্য রোগেও প্রাণ হারাচ্ছে শিশুরা।
সচেতনতা, সময়মতো চিকিৎসা ও টিকা গ্রহণ—এই তিনটি বিষয়েই জোর দিতে হবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
বিশ্ব প্রেক্ষাপট
বিশ্বজুড়ে প্রতিবছর আট লাখের বেশি শিশুর প্রাণ কাড়ে নিউমোনিয়া। আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জানিয়েছে, টিকা, বিশুদ্ধ বায়ু ও পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করলে শিশু নিউমোনিয়ার ৯০ শতাংশ মৃত্যু প্রতিরোধযোগ্য।
উপসংহার
নিউমোনিয়া একটি প্রতিরোধযোগ্য কিন্তু প্রাণঘাতী রোগ। সময়মতো টিকা, সচেতনতা, এবং চিকিৎসকের পরামর্শ মানলে এ মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো সম্ভব। এখনই প্রয়োজন নতুন প্রজন্মের টিকা চালু করা এবং জনগণকে সচেতন করা—যাতে আর কোনো শিশুকে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে বাঁচার লড়াই না করতে হয়।
