অনলাইন ডেস্ক:
চলতি বছরের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার পুনঃনিরীক্ষণ ফলাফল প্রকাশ করেছে দেশের ১১টি সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ড। রোববার (১৬ নভেম্বর) সকাল থেকেই বোর্ডগুলোর পৃথক ওয়েবসাইটে একযোগে ফল প্রকাশ শুরু হয়। একই সঙ্গে যেসব শিক্ষার্থী খাতা পুনঃনিরীক্ষণের (খাতা চ্যালেঞ্জ) জন্য আবেদন করেছিলেন, তাদেরও এসএমএসের মাধ্যমে ফল জানানো হচ্ছে।
এবার পুনঃনিরীক্ষণের জন্য যে বিপুল সংখ্যক আবেদন জমা পড়েছে, তা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নতুন রেকর্ড। ফল প্রকাশের পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগ ও ক্ষোভের কারণে আবেদন সংখ্যা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। শিক্ষাবোর্ড–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দেশে মোট ২ লাখ ২৬ হাজার শিক্ষার্থী তাদের ৪ লাখ ২৮ হাজার খাতা পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন করেছেন। এই সংখ্যা গত কয়েক বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি।
ঢাকা বোর্ডে সর্বাধিক আবেদন, সর্বনিম্ন বরিশালে
১১টি শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবেদন জমা পড়ে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে, যেখানে সবচেয়ে কম আবেদন এসেছে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডে। শিক্ষাবোর্ডের কর্মকর্তারা বলছেন, ঢাকা বোর্ডের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় আবেদনও তুলনামূলক বেশি। পাশাপাশি বড় শহর হওয়ায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সচেতনতা ও আগ্রহও বেশি ছিল।
বিষয়ভিত্তিকভাবে সবচেয়ে বেশি পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন এসেছে ইংরেজি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিষয়ে। সাধারণত ইংরেজিতে নম্বর কম পাওয়া ও আইসিটির হিসাবভিত্তিক প্রশ্নের কঠোর মূল্যায়ন অনেক শিক্ষার্থীকে পুনঃনিরীক্ষণের দিকে ঠেলে দেয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
আবেদন প্রক্রিয়া চলেছে গত ১৭ অক্টোবর থেকে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত মোট সাত দিন। শিক্ষার্থীরা প্রতি বিষয়ে ১৫০ টাকা ফি দিয়ে আবেদন করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা টেলিটকের নির্ধারিত এসএমএস পদ্ধতির মাধ্যমে আবেদন জমা দেন।
ফল বিপর্যয়ের প্রভাব: উচ্চশিক্ষায় প্রবেশ সংকট
২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার মূল ফল প্রকাশিত হয় ১৬ অক্টোবর। এবার পাসের হার ৫৮ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গতবারের ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে প্রায় ১৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। এই ধরনের বড় হারে ফল বিপর্যয় দেশের শিক্ষা কাঠামোর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে।
এ বছর জিপিএ-৫ পেয়েছেন ৬৯ হাজার ৯৭ জন, যেখানে গতবছর এই সংখ্যা ছিল প্রায় ১ লাখ ৪৬ হাজার। অর্থাৎ এই বছর জিপিএ-৫ কমেছে ৭৬ হাজার ৮১৪টি। পাসের হার কমে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে প্রায় ১১ লাখ আসন ফাঁকা থাকার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষা বিশ্লেষকদের মতে, এমন ফল বিপর্যয় একদিকে শিক্ষার্থীদের মনোবল ভেঙে দিয়েছে, অন্যদিকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভর্তি কাঠামো ও পরিকল্পনায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে। অনেক প্রতিষ্ঠানে আসন পূরণের সংকট তৈরি হতে পারে, যা শিক্ষা খাতে আর্থিক ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে।
পরীক্ষা আয়োজন ও পুনর্মূল্যায়ন প্রক্রিয়া
চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছিল ২৬ জুন এবং শেষ হয় ১৯ আগস্ট। এরপর ২১ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় ব্যবহারিক পরীক্ষা। পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার প্রায় দুই মাস পর ফলাফল প্রকাশ করে শিক্ষা বোর্ড।
ফল প্রকাশের পর হাজার হাজার শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন—তাদের প্রত্যাশিত নম্বর পাওয়া হয়নি, এবং মূল্যায়নে ভুল থাকতে পারে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে এই অভিযোগ উঠতে শুরু করলে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন জমা হয় ব্যাপক হারে। অনেক শিক্ষার্থী জানান, তাদের নম্বর অস্বাভাবিকভাবে কম এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নে অসঙ্গতি থাকতে পারে।
পুনঃনিরীক্ষণ প্রক্রিয়ায় খাতা নতুন করে মূল্যায়ন করা হয় না; বরং—
- নম্বর যোগ–বিয়োগ সঠিক হয়েছে কি না,
- কোন প্রশ্ন বাদ পড়ে গেছে কি না,
- অথবা উত্তরের মূল্যায়ন সঠিকভাবে নথিভুক্ত হয়েছে কি না—
এসব বিষয়ই যাচাই করা হয়।
শিক্ষাবোর্ডগুলোর মতে, এত বিশাল পরিমাণ আবেদন দ্রুত ও সঠিকভাবে যাচাই করা একটি চ্যালেঞ্জ ছিল, তবে নির্ধারিত সময়ের আগেই পুনঃনিরীক্ষণের ফল প্রকাশ করা সম্ভব হয়েছে।
শিক্ষা বোর্ডগুলোর অবস্থান
শিক্ষাবোর্ডের একজন কর্মকর্তা বলেন—
“এবার পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন সংখ্যায় আমরা সত্যিই বিস্মিত। দেশব্যাপী ফলাফল নিয়ে যে অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল, তারই প্রতিফলন দেখা গেছে আবেদন সংখ্যায়। আমরা স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা নিয়েছি।”
অন্যদিকে বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন বলছে, পুনঃনিরীক্ষণের ফলাফল প্রকাশ স্বচ্ছতা বজায় রাখতে সহায়তা করলেও, মূল সমস্যার সমাধান করতে হবে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায়।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিক্রিয়া
ফলাফলে অসন্তুষ্ট শিক্ষার্থীরা পুনঃনিরীক্ষণে কিছুটা আশাবাদী হলেও কেউ কেউ প্রকাশ্যে জানিয়েছেন যে কেবল খাতা চ্যালেঞ্জে সমস্যার পূর্ণ সমাধান হয় না।
একজন পরীক্ষার্থী বলেন,
“আমি ইংরেজিতে ভালো লিখেছি, কিন্তু নম্বর কম পেয়েছি। পুনঃনিরীক্ষণে যদি নম্বর ঠিক হয়, তাহলে ভবিষ্যতের ভর্তিপরীক্ষায় উপকার হবে।”
অভিভাবকরা মনে করছেন—মূল্যায়ন পদ্ধতিতে স্বচ্ছতা বাড়ানো গেলে পুনঃনিরীক্ষণের আবেদন কমে আসবে।
আগামীতে কী প্রত্যাশা
শিক্ষাবোর্ড ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সামনে এখন দুটি বড় চ্যালেঞ্জ—
- এইচএসসি ফলাফলের দুর্বলতা কাটিয়ে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি প্রক্রিয়া স্বাভাবিক রাখা
- মূল্যায়ন ও পরীক্ষাপদ্ধতি আরও উন্নত করে ভবিষ্যতে এমন ফল বিপর্যয় রোধ করা
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রযুক্তিনির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা, পরীক্ষকের প্রশিক্ষণ এবং বিষয়ভিত্তিক রিভিউ কাঠামো উন্নয়ন করা জরুরি।
