ভোজ্যতেলের দাম বাড়ছে, কত টাকা বাড়বে নির্ধারণে সরকারের হিসাব চলছে

দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সারি, ভোক্তারা উদ্বিগ্ন মুখে দাম যাচাই করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো হচ্ছে, তবে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবিত ১০ টাকা বাড়ানোতে রাজি নয় সরকার। ছবি সংগ্রহীত

অনলাইন ডেস্ক:

ঢাকা প্রতিনিধি

বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের দাম আবারও বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকপক্ষ সরকারকে লিটারপ্রতি দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। তবে ব্যবসায়ীরা যতটা মূল্য বাড়ানোর দাবি তুলেছেন, সরকার তাতে সম্মতি দিচ্ছে না। সরকারও কিছুটা মূল্যবৃদ্ধিতে রাজি হয়েছে, কিন্তু কত টাকা বাড়ানো হবে, তা নিয়ে এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।

সচিবালয়ের বৈঠক

গত সোমবার সচিবালয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সভাপতিত্বে ভোজ্যতেলের বাজার পরিস্থিতি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) চেয়ারম্যান মইনুল খান এবং বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্যরা।

বৈঠকে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর, বিটিটিসির প্রস্তাবিত ফর্মুলা এবং ব্যবসায়ীদের দাবির ভিত্তিতে দেশীয় বাজারে নতুন দাম নির্ধারণের আলোচনা হয়। তবে বৈঠক শেষে কোনো পক্ষই সাংবাদিকদের কিছু জানাননি।

ব্যবসায়ীদের দাবি বনাম সরকারের অবস্থান

ভোজ্যতেল পরিশোধন কারখানার মালিকরা সয়াবিন তেল ও পাম তেলের দাম লিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছেন। তাদের যুক্তি, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম প্রতি টনে ১ হাজার ২০০ ডলারে পৌঁছেছে, ফলে আমদানিকৃত ভোজ্যতেলের খরচ বেড়েছে।

অন্যদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মালিকদের প্রস্তাবিত দাম আন্তর্জাতিক বাজারদরের তুলনায় অনেক বেশি। সরকার ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিতে চায় না। তাই যৌক্তিক পরিমাণে দাম বাড়ানোর হিসাব করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও বিটিটিসি

বাণিজ্যসচিব মাহবুবুর রহমান জানান, “দাম বাড়তে পারে ঠিক, তবে তা কত টাকা হবে সেটি আমরা যাচাই করছি। ব্যবসায়ীদের প্রস্তাব আমরা পর্যালোচনা করছি।”

আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব

সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যপণ্যের দাম ওঠানামা করছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি এবং সরবরাহ শৃঙ্খলের বিঘ্নের কারণে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। ফলে আমদানি নির্ভর বাংলাদেশেও তার প্রভাব পড়ছে।

বাংলাদেশে ব্যবহৃত ভোজ্যতেলের বেশিরভাগই আমদানিনির্ভর। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশের ভেতরও দাম সমন্বয় করা ছাড়া বিকল্প থাকে না। তবে সরকার মনে করছে, ব্যবসায়ীরা সুযোগ নিয়ে অতিরিক্ত মুনাফার চেষ্টা করছে।

ভোক্তাদের উদ্বেগ

দেশে ইতোমধ্যেই নিত্যপণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী। চাল, ডাল, সবজি ও মাংসের পাশাপাশি ভোজ্যতেলের দাম বাড়লে সাধারণ ভোক্তারা আরও চাপে পড়বে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য খাদ্য ব্যয় সামলানো কঠিন হয়ে উঠবে।

ভোক্তা অধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকারকে আন্তর্জাতিক বাজারের বাস্তবতা বিবেচনা করতে হবে, তবে একইসাথে ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক প্রস্তাব প্রতিহত করতে হবে। অন্যথায় ভোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

সরকারের করণীয়

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যেই বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) মাধ্যমে ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারদর ও স্থানীয় ব্যয় কাঠামো যাচাই করেছে। এখন সেই রিপোর্টের ভিত্তিতেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে।

সম্ভাবনা রয়েছে, সরকার লিটারপ্রতি ৫ থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি অনুমোদন করতে পারে, তবে ব্যবসায়ীদের প্রস্তাবিত ১০ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না।

পূর্ব অভিজ্ঞতা

বাংলাদেশে এর আগে কয়েকবার ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। প্রতিবারই আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হলেও বাজারে স্থিতিশীলতা আসেনি। বরং ব্যবসায়ীরা প্রায়ই একচেটিয়া প্রভাব খাটিয়ে মজুতদারি ও কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সরকারের পক্ষ থেকে নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা হলেও বাস্তবে দাম নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। তাই এবারও ভোক্তাদের আশঙ্কা—মূল্যবৃদ্ধি হলেও বাজারে ন্যায্য দাম বজায় রাখা কঠিন হবে।

উপসংহার

ভোজ্যতেলের দাম বাড়ানো এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। তবে সরকার কতটা বাড়াবে, তা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক বাজারদর ও ভোক্তার স্বার্থের ভারসাম্যের ওপর। ব্যবসায়ীরা যেমন ১০ টাকা বাড়ানোর চাপ দিচ্ছে, সরকার ততটা বাড়াবে না—এটাই এখন পর্যন্ত স্পষ্ট ইঙ্গিত।

ভোক্তাদের স্বস্তি বজায় রাখতে সরকারের উচিত হবে মূল্যবৃদ্ধির সাথে সাথে বাজার মনিটরিং আরও কঠোর করা, যাতে কৃত্রিম সংকট বা অতিরিক্ত মুনাফার মাধ্যমে জনগণকে ভোগান্তিতে না ফেলা হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *