রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের

নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে বক্তব্য রাখছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাইড ইভেন্টে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানোর আহ্বান জানালেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ছবি : প্রধান উপদেষ্টা প্রেস উইং

অনলাইন ডেস্ক:

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিতে যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়ে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আবারও বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ বর্তমানে নানা চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, দারিদ্র্য, বৈষম্য, শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রাম মানবতার অস্তিত্বকে কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছে। এর মধ্যে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয়ের দায়িত্ব বাংলাদেশ কাঁধে নিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়।

স্থানীয় সময় সোমবার (২২ সেপ্টেম্বর) নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দফতরে অনুষ্ঠিত “সোশ্যাল বিজনেস, ইয়ুথ অ্যান্ড টেকনোলজি” শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের সাইড ইভেন্টে তিনি এসব কথা বলেন।

মানবিক দায়িত্ব ও ন্যায়সঙ্গত উত্তরণ

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্ব আজ সংকটময় এক সময় অতিক্রম করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব প্রতিদিন আরও স্পষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এ ছাড়াও বৈষম্য গভীরতর হচ্ছে, শান্তি ও ন্যায়বিচারের সংগ্রাম আরও জটিল আকার ধারণ করছে। এই বাস্তবতায় বিশ্বকে এমন এক অর্থনৈতিক মডেলের দিকে এগোতে হবে, যা মানুষের কল্যাণ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং পরিবেশ সংরক্ষণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেবে।

ড. ইউনূস বলেন, বাংলাদেশ এমন এক সময়ে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যখন আমাদের কাঁধে ১৩ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয়ের বিশাল দায়িত্ব। “এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা কমানো বা জাতিসংঘের বাজেট হ্রাস করা আমাদের জন্য প্রতিকূল প্রভাব ফেলবে। বরং আন্তর্জাতিক সহায়তা বাড়ানো এবং ন্যায়সঙ্গত উত্তরণের পথ নিশ্চিত করা জরুরি।”

রোহিঙ্গা সংকট: বৈশ্বিক দায়িত্ব

বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ২০১৭ সাল থেকে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নিরাপত্তার দায়িত্ব প্রতিদিন আরও জটিল হয়ে উঠছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে প্রাপ্ত সহায়তা তুলনামূলকভাবে কমছে। এতে কক্সবাজার ও আশপাশের অঞ্চলে চাপ বাড়ছে এবং পরিবেশ ও অর্থনৈতিক অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

প্রধান উপদেষ্টা মনে করেন, রোহিঙ্গা সংকট শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়; এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক ও রাজনৈতিক সংকট। “এই সমস্যার টেকসই সমাধান নিশ্চিত না হলে এটি আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে,” তিনি বলেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর

ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদল নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। সফরসঙ্গী হিসেবে রয়েছেন ছয়জন উপদেষ্টা এবং বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতৃবৃন্দ। জাতিসংঘ প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তিনি রোহিঙ্গা সংকটের ন্যায্য সমাধান, জলবায়ু ন্যায়বিচার এবং সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সম্পৃক্ত করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিচ্ছেন।

অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবসা ও ভবিষ্যৎ

ড. ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসা এবং প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে এমন এক নতুন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে, যেখানে মুনাফার চেয়ে মানবকল্যাণকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। তরুণ প্রজন্মকে এই যাত্রায় নেতৃত্ব দিতে হবে। প্রযুক্তির সুবাদে নতুন কর্মসংস্থান, উদ্ভাবন এবং উদ্যোক্তা তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব।

তিনি সতর্ক করেন, যদি বর্তমান বৈষম্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানবিক সংকট উপেক্ষিত হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি ভয়ঙ্কর সংকটময় পৃথিবী উত্তরাধিকার পাবে। তাই বিশ্ব নেতাদের এখনই সম্মিলিত পদক্ষেপ নিতে হবে।

বাংলাদেশের অবস্থান

বাংলাদেশ বারবার আন্তর্জাতিক মহলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়েছে। তবে মিয়ানমারের রাজনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বারবার থমকে যাচ্ছে। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক সহায়তা না বাড়লে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হবে এবং স্থানীয় অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ ফেলবে।

প্রধান উপদেষ্টা মনে করিয়ে দেন, বাংলাদেশের মানুষ মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে এই বোঝা বহন করা সম্ভব নয়। “আমরা চাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য আরও সক্রিয় ভূমিকা নিক। সহায়তা বৃদ্ধি করুক এবং প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াকে বাস্তবায়নের পথ সহজ করুক।”

উপসংহার

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্য কেবল বাংলাদেশের নয়, পুরো বিশ্বের জন্য একটি সতর্কবার্তা। তিনি রোহিঙ্গা সংকটকে বৈশ্বিক দায়িত্ব হিসেবে তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, সহায়তা কমালে নয় বরং বাড়ালেই এই সংকটের টেকসই সমাধান সম্ভব। একইসাথে তিনি সামাজিক ব্যবসা ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নতুন অর্থনীতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিশ্ব সম্প্রদায় কতটা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের এই আহ্বানে সাড়া দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *