অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পরই নেপালে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

নেপালের অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কি ও প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাওদেলের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার দৃশ্য। প্রথম নারী অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই নেপালে ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা। ছবি রয়টার্স

অনলাইন আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

সূত্র: রয়টার্স

রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দিয়ে যাওয়া নেপালে নতুন এক অধ্যায় শুরু হলো। দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে চলমান সহিংস আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রী কে. পি. শর্মা ওলি পদত্যাগে বাধ্য হওয়ার পর দেশটির প্রথম নারী অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাওদেল পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে আগামী ৫ মার্চ জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন।

এই ঘোষণাকে ঘিরে নেপালের রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা তৈরি হলেও, একই সঙ্গে জনগণের মধ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রত্যাশা জন্ম দিয়েছে।


রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা

নেপালের রাজনৈতিক সংকটের শুরু মূলত দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির বিরুদ্ধে ছাত্র ও নাগরিক আন্দোলন থেকে। ওলি সরকারের সময়ে একের পর এক অভিযোগ জমতে থাকে—

  • সরকারি পদে আত্মীয়-স্বজনকে প্রাধান্য দেওয়া
  • দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ
  • ভুয়া তথ্য রোধের নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা

এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলন দ্রুত সহিংস রূপ নেয়। এ পর্যন্ত সহিংসতায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৫১ জন এবং আহত হয়েছেন এক হাজার ৩০০ জনের বেশি


ওলি সরকারের পতন

চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী কে. পি. শর্মা ওলি অবশেষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এতে দেশের নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার প্রশ্নে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীদারদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। অবশেষে আপসহীন অবস্থার কারণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান: সুশীলা কার্কি

সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি নেপালের ইতিহাসে প্রথম নারী হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন। শুক্রবার শপথগ্রহণের মাধ্যমে তিনি নতুন যাত্রা শুরু করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তিনি পরামর্শ দেন পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার এবং দ্রুত নির্বাচনের। তার পরামর্শে প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাওদেল পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেন এবং নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেন।


নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা

প্রেসিডেন্টের কার্যালয় থেকে শুক্রবার রাতে জানানো হয় যে, আগামী ৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে হাউজ অব রিপ্রেজেনটেটিভস (পার্লামেন্ট) আনুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

এই সিদ্ধান্তকে অনেকে সাহসী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন, আবার কেউ কেউ বলছেন—সময়টা আরও প্রস্তুতির দাবি রাখে।


সহিংসতার পর স্বাভাবিক অবস্থা

একটানা কয়েকদিনের সহিংসতার পর শুক্রবার থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে।

  • দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে
  • সড়কে যানবাহন চলাচল বাড়ছে
  • জনজীবনে স্বস্তি ফিরছে

এটি জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে যে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নেপাল আবারও স্থিতিশীল হবে।


প্রতিবেশী ভারতের প্রতিক্রিয়া

নেপালে রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান এবং নির্বাচন ঘিরে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে প্রতিবেশী দেশ ভারত আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। ভারতের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নেপালের জনগণের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানানো হবে এবং দেশটিতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ভারত সহযোগিতা করবে।


চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা

অন্তর্বর্তী সরকার এবং আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নেপালের সামনে রয়েছে একাধিক চ্যালেঞ্জ:

  1. সহিংসতা নিয়ন্ত্রণ – বিক্ষোভ যাতে আবারও ছড়িয়ে না পড়ে
  2. স্বচ্ছ নির্বাচন – আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা
  3. অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা – সহিংসতার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা
  4. আন্তর্জাতিক আস্থা ফেরানো – বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা

তবে এর পাশাপাশি সম্ভাবনাও রয়েছে। প্রথমবারের মতো নারী অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান জনগণের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে তরুণরা মনে করছেন, এটি নেপালের রাজনীতিতে পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।


জনগণের প্রত্যাশা

নেপালের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের প্রত্যাশা করে আসছে। তারা আশা করছে—

  • দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন
  • স্বজনপ্রীতির অবসান
  • গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশ
  • সাধারণ মানুষের মতামতের প্রতিফলন

এই প্রত্যাশা পূরণ করতে পারলেই নির্বাচনের পর নেপাল নতুন পথে হাঁটতে পারবে।


নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি শুধু রাজনৈতিক নয়, বরং সামাজিক ও মানবিকও। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা দেশটির ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হবে। মার্চ মাসের নির্বাচনের ফলাফলই নির্ধারণ করবে নেপাল কেমন পথে এগোবে—অস্থিতিশীলতার দিকে নাকি স্থায়ী শান্তি ও উন্নয়নের দিকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *