বদরুদ্দীন উমর আর নেই: ৯৪ বছর বয়সে প্রস্থান এক প্রভাবশালী চিন্তকের

হাসপাতালের বাইরে বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে শোকাহত মানুষের ভিড়। বামপন্থি রাজনীতিক ও লেখক বদরুদ্দীন উমর আর নেই, ৯৪ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ। ছবি সংগ্রহীত

অনলাইন ডেস্ক:

বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতি ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব বদরুদ্দীন উমর আর নেই। দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন এই লেখক ও রাজনীতিবিদ। রবিবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকাল ১০টা ৫ মিনিটে রাজধানীর শ্যামলীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

শারীরিক অবস্থা ও মৃত্যুর খবর

গত ২২ জুলাই শ্বাসকষ্ট ও নিম্ন রক্তচাপ নিয়ে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। টানা দশদিন চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন। তবে শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় রোববার সকালে তাঁকে পুনরায় হাসপাতালে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও সকাল ১০টা ৫ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

জন্ম ও পরিবার

১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে জন্ম নেন বদরুদ্দীন উমর। তাঁর বাবা আবুল হাশিম ছিলেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা মুসলিম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ। পরিবার থেকেই তিনি রাজনৈতিক চেতনার উত্তরাধিকার পান, যা পরবর্তীতে তাঁর জীবনের মূল চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে।

লেখক ও গবেষক হিসেবে অবদান

ষাটের দশকে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ নাম। বিশেষ করে ধর্ম, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর গবেষণা ও রচনা তরুণ প্রজন্মের চিন্তাজগতে নতুন আলোড়ন তোলে।

তাঁর সবচেয়ে আলোচিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • ‘সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৬) – যেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন সমাজে বিভাজনের মূল কারণ।
  • ‘সংস্কৃতির সংকট’ (১৯৬৭) – সাংস্কৃতিক পরিচয় ও সংকটের বিশ্লেষণ।
  • ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ (১৯৬৯) – সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িকতার সম্পর্ক তুলে ধরা।

এই বইগুলো স্বাধীনতার পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

নীতিগত অবস্থান

বদরুদ্দীন উমর কেবল লেখক ছিলেন না; তিনি ছিলেন এক অবিচল রাজনৈতিক চিন্তক। শাসকগোষ্ঠীর অধীনে চাকরি করবেন না—এই বিশ্বাসে তিনি নিজের চাকরি থেকেও পদত্যাগ করেছিলেন। তাঁর এই অবস্থান ছিল নীতিনিষ্ঠা ও আত্মমর্যাদার প্রতীক।

রাজনৈতিক ভূমিকা

বামপন্থি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তিনি। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর চিন্তা ও মতাদর্শের প্রভাব আজও বাংলাদেশের বামপন্থি রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়।

জাতির ক্ষতি

বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে দেশের বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক মহল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। অনেকে তাঁকে মনে করছেন “এক যুগের শেষ প্রহরী” হিসেবে, যিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন।

সমাপনী কথা

৯৪ বছরের দীর্ঘ জীবন শেষে বদরুদ্দীন উমর আজ আমাদের মাঝে নেই। তবে তাঁর লেখা, তাঁর চিন্তা এবং তাঁর সংগ্রামী জীবনচেতনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বারবার অনুপ্রাণিত করবে। বাংলাদেশে সংস্কৃতি, রাজনীতি ও জাতীয়তাবাদী চিন্তার ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *