অনলাইন ডেস্ক:
রোববার (৩১ আগস্ট) সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর নায়ে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সংবাদ ব্রিফ দেন। প্রায় এক ঘণ্টা দীর্ঘ বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন, বিচার, স্বচ্ছতা, সংস্কার, এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন সমসাময়িক রাজনৈতিক বিষয় আলোচনায় উঠে এসেছে।
১. নির্বাচন: অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক
তাহের ব্রিফে জানালেন, বৈঠকের মূল আঙ্গিনায় ছিল “নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার করণীয়”, এবং এটি নিশ্চিত করার জন্য বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করা হবে। প্রধান উপদেষ্টার তিনটি প্রাধান্যমণ্ডিত ক্ষেত্র উল্লেখ করা হয়েছে: সংস্কার, বিচার, এবং সুষ্ঠু নির্বাচন—এই তিনটি একসঙ্গে মিললে আগামীর নির্বাচন গণতন্ত্রের বাস্তবানুগ মঞ্চ হতে পারে।
২. নীলনকশার নির্বাচন? সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নে
তাহের বলেন, জনগণের মনে প্রশ্ন জেগেছে—“নীলনকশার নির্বাচন হচ্ছে কি না?”। তিনি উল্লেখ করেন, “লন্ডনে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা” করা একটি নজিরবিহীন ঘটনা যেন সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নের খাতায় জড়িয়ে ফেলেছে। পরিকল্পিত কোনো নির্বাচন হলে, গণতন্ত্রলালসা মানুষের কাছে অংশগ্রহণ সংকুচিত হয়ে যেতে পারে। তাই নির্বাচন কার্যকারিতার প্রশ্নে জামায়াত ভিন্নমত পোষণ করেছে।
৩. পিআর পদ্ধতির প্রেসক্রিপশন: অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে
তফশিলভুক্ত ৩১টি দলের মধ্যে ২৫টি দল পিআর (প্রদান প্রতিস্থান) পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। শুধু উচ্চকক্ষে নয়, দুই কক্ষে পিআর যোগ করতে হবে—এটি দলের যুক্তি। এতে কেন্দ্র দখল থেকে বিরত থাকতে এবং ‘মেজরিটি অবজ্ঞা’ থেকে বিরত থাকতে পরিস্থিতি সুষ্ঠর হবে, নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবেনা, এবং গণতান্ত্রিক গণভোটে অংশগ্রহণ বাড়বে।
৪. ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে আইনি ভিত্তি দাবি
তাহের অভিযোগ করেন, কিছু দল জুলাই সনদ বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছে। জামায়াত প্রধান উপদেষ্টার কাছে “আইনি ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়া উচিত” এমন দাবি তুলেছে। তিনি বলেন, জুলাই সনদের অধীনে যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে এটি জুলাই শহীদদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হবে। অর্থাৎ, গত বিক্ষোভ ও গণতন্ত্রের লালিত মর্যাদা রক্ষাবলই প্রকৃত ভিত্তিতে নির্বাচন হবে।
৫. প্রশাসনে অংশগ্রহণকারী ‘দখলদার’ গ্রুপের প্রতি উদ্বেগ
তাহের বলেন, এই সরকার দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারেনি। আগে একটি গ্রুপ, এখন আরেকটি দল বাসস্ট্যান্ডসহ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল করে রেখেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। তার ভাষায়: “সরকার হাত-পা ছেড়ে দিয়েছে”—এই ভাবেই নির্বাচনের প্রাক্কালে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। তবে যোগ করেন, এখনো যদি সরকার কঠোর হয়, উত্তরণ সম্ভব।
৬. ভোটারদের কাছে পিআর ও ‘জুলাই সনদ’ নিয়ে আলোচনা
একটি দল ছাড়া সব দল জুলাই সনদ ও পিআর নিয়ে জনগণের কাছে গিয়ে গণভোট আয়োজন করা উচিত। সরকারের উচিত স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। একইভাবে, রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মধ্য আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন।
৭. নুরুল হক নুরের ওপর হামলার বিচার দাবী
নুরুল হক নুরদের ওপর হামলার ঘটনা “ষড়যন্ত্রমূলক”—এই ধরনের আক্রমণের দোষীদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তাহের। এই ঘটনার গভীরতা বিবেচনায়, তার বিচার নিশ্চিত হওয়া জরুরি বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
৮. জাতীয় পার্টি: একই আঙিনায় বিচার
তাহের অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের সহযোগী হিসেবে জাতীয় পার্টি কাজ করেছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ঘোষিত যে সিদ্ধান্ত আছে, জাতীয় পার্টির ব্যাপারেও সেই একই নীতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ হতে পারে।
৯. প্রশাসন থেকে ‘ফ্যাসিবাদের দালাল’ অপসারণের দাবি
বৈঠকের এক উল্লেখযোগ্য দাবি ছিল—“ফ্যাসিবাদের দালালদের প্রশাসন থেকে সরিয়ে দিতে হবে”। জামায়াত মনে করে, প্রশাসনিক স্তরে অনৈতিক এবং স্বৈরাচার-উদ্দীপক ভূমিকা পালনকারীদের শাস্তি ও অপসারণ সংগঠন ও দেশকে ন্যায় ও গণতন্ত্রপন্থার পথে ফিরিয়ে আনবে।
উপসংহার
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জামায়াত প্রতিনিধিদের আজকের বৈঠক ছিল নির্বাচন, বিচার, সংস্কার—এই তিন শক্তিশালী স্তম্ভকে ঘিরে। নির্বাচন কাঠামোর স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণমূলকতা, আইন ও সামাজিক কাঠামোর রূপান্তর—এসব ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। সামগ্রিক প্রশাসনিক পরিস্থিতি, ভোট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং অ্যাকাউন্টেবিলিটি বজায় রেখে আগাম নির্বাচন—এখানেই আজকের বৈঠকের মূল সার।
