নওগাঁয় ঝড়ের তাণ্ডব: ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে প্রশাসন

নওগাঁয় ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের টিন উড়ে গেছে, প্রশাসন দুর্গতদের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করছে। নওগাঁয় আকস্মিক ঝড়ে ঘরবাড়ি ও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি — দুর্গতদের সহায়তায় মাঠে জেলা প্রশাসন। ছবি বাসস

অনলাইন ডেস্ক:

নওগাঁ, ৬ অক্টোবর ২০২৫:
নওগাঁ জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া আকস্মিক ঝড় লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে তিনটি উপজেলা — পত্নীতলা, মহাদেবপুর ও সদর
শনিবার (৪ অক্টোবর) বিকেল ৪টার দিকে প্রায় আধা ঘণ্টাব্যাপী এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতাধিক ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও ফসলের ক্ষেত।
বহু গাছ উপড়ে পড়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে গেছে, ফলে বহু এলাকা অন্ধকারে ডুবে গেছে।


ঝড়ের ভয়াবহতা

বদলগাছী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র জানিয়েছে—ঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫১ কিলোমিটার, আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ২০ মিলিমিটার
অল্প সময়ের এই ঝড়েই নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ঝড়ের পর থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে ওই এলাকার অনেক গ্রাম।
বিশেষ করে পত্নীতলা উপজেলার ভাবিচা, দোচাই, যুগীবাড়ি, রঘুনাথপুরসহ ২০টিরও বেশি গ্রামে ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পল্লি বিদ্যুৎ রিজিয়ন–২ জানিয়েছে, বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে এবং তার ছিঁড়ে যাওয়ায় ৯ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়েছে।
সংযোগ মেরামতের কাজ চললেও পুরোপুরি বিদ্যুৎ ফেরাতে সময় লাগবে বলে জানা গেছে।


কৃষকের কান্না—ফসলের ক্ষতি

এই ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে কলা ও পেঁপে বাগানে।
৪০ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যা টাকার অঙ্কে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকার ক্ষতি বলে জানিয়েছে উপজেলা কৃষি অফিস।

ভাবিচা গ্রামের কলাচাষি ফজর উদ্দিন বলেন,

“১০ কাঠা জমির কলাবাগানের সব গাছ ভেঙে গেছে। প্রায় ৩০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়েছে।”

অন্যান্য কৃষকরাও জানান, ঘরবাড়ি ও দোকানপাট ছাড়াও ধানের জমিও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
অনেকে ধারদেনা করে ফসল ফলিয়েছিলেন, এখন সেটাও গেছে।


মানুষ খোলা আকাশের নিচে

ঝড়ের পর থেকে অনেক মানুষ রাতের অন্ধকারে খোলা আকাশের নিচে সময় কাটাচ্ছেন।
ঘরের টিন উড়ে যাওয়ায় কেউ কেউ আত্মীয়ের বাড়িতে, কেউ আবার গ্রামের স্কুলে আশ্রয় নিয়েছেন।

ভাবিচা গ্রামের রেজাউল করিম বাবু বলেন,

“এমন ঝড় আগে দেখিনি। মাত্র ২০ মিনিটে সব উড়ে গেল। বিদ্যুতের খুঁটি পড়ে আছে, ২৫ ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ নেই।”

একই গ্রামের জামাল উদ্দিন বলেন,

“চার ঘরের টিন উড়ে গেছে। সব খাবার ও জামাকাপড় ভিজে গেছে। নতুন টিন কিনে মেরামত করছি।”

দোচাই গ্রামের দিনমজুর পল্লব জানান,

“ঝড়ের সময় আমি বাড়িতে ছিলাম না। ঘরের বাঁশ ভেঙে স্ত্রীর পায়ে পড়েছে, তিনি আহত হয়েছেন। উপজেলা থেকে এক বস্তা শুকনা খাবার পেয়েছি।”


প্রশাসনের পাশে দুর্গত মানুষ

ঘটনার পরদিন, রোববার (৫ অক্টোবর), ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আশিকুর রহমান ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আলীমুজ্জামান মিলন
তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের হাতে শুকনা খাবার তুলে দেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আলীমুজ্জামান মিলন বলেন,

“ক্ষতিগ্রস্তদের তাৎক্ষণিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। যাদের টিন উড়ে গেছে তাদের টিন দেওয়া হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণ টিন মজুত রয়েছে।”

তিনি আরও জানান, জেলা প্রশাসন থেকে ৫ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
পরবর্তীতে ক্ষতির পরিমাণ অনুযায়ী আরও সহায়তা দেওয়া হবে।


কৃষি অফিসের উদ্যোগ

পত্নীতলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সোহরাব হোসেন বলেন,

“ঝড়ে প্রায় ৪০ হেক্টর জমির কলা ও পেঁপে বাগান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষকদের সহায়তায় প্রণোদনা দেওয়ার জন্য তালিকা প্রস্তুত করা হচ্ছে।”

তিনি জানান, অনেক কৃষক বাগান ভেঙে যাওয়ার পরও নতুন করে চারা লাগানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন।
কৃষি বিভাগ তাদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও বীজ সহায়তা দেবে।


বিদ্যুৎ বিভাগের তৎপরতা

ঝড়ের সময় পত্নীতলায় অন্তত ৬০টি বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ে
এর ফলে ৩০টি গ্রাম বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়ে।
পল্লি বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীরা দিনরাত কাজ করছেন সংযোগ পুনঃস্থাপনের জন্য।


উপসংহার

অল্প সময়ের ঝড়ে নওগাঁর গ্রামীণ জীবনে নেমে এসেছে ভয়াবহ বিপর্যয়।
তবে জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও বিদ্যুৎ কর্মকর্তাদের দ্রুত পদক্ষেপে মানুষের পাশে দাঁড়ানোয় ক্ষতি কিছুটা সামাল দেওয়া সম্ভব হচ্ছে।

গ্রামীণ মানুষ এখন একটাই প্রত্যাশা করছেন —
“বৃষ্টি আর ঝড় যেন না আসে, আবার যেন ঘরে ফেরা যায়।”

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *