৯টি ব্যাংকবহির্ভূত প্রতিষ্ঠান বন্ধ, আমানতকারীদের ভবিষ্যৎ কী?

বাংলাদেশ ব্যাংকের ভবন সামনে, সামনে একটি ব্যক্তির হাতে সঞ্চয়ের টাকা তুলে নেওয়ার ছবি — আমানতকারীদের নিরাপত্তা ও ফেরতের ধারণা প্রতীকীভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক: ৯টি দুর্বল NBFI-এর লিকুইডেশন, যাতে আমানতকারীরা নিরাপদে তাদের টাকা ফেরত পান।

অনলাইন ডেস্ক:

দেশের অর্থনীতির অঙ্গনে নতুন এক সঙ্কেত—বাংলাদেশ ব্যাংক এবার ৯টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (NBFI) বন্ধ করার পথে হাঁটছে। একসময় যেগুলো আমানতকারীদের কাছে ছিল ভরসার জায়গা, আজ সেগুলো অনিয়ম, দুর্নীতি আর খেলাপি ঋণের বোঝায় নুয়ে পড়েছে। প্রশ্ন উঠেছে—যারা তাদের কষ্টার্জিত টাকা এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে জমা রেখেছিলেন, তারা কি শেষমেশ টাকাটা ফিরে পাবেন?


কোন প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হচ্ছে?

প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম শুনলেই অনেক আমানতকারীর বুক ধক করে উঠবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যেগুলোকে ‘অবসায়নের তালিকায়’ ফেলেছে, সেগুলো হলো:

  • ফাস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
  • বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (BIFC)
  • প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স
  • ফারইস্ট ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
  • জিএসপি ফাইন্যান্স কোম্পানি
  • প্রাইম ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট
  • আভিভা ফাইন্যান্স
  • পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স
  • ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স

এই প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের পর বছর ধরে অনিয়মে জর্জরিত ছিল। বিনিয়োগে স্বচ্ছতা ছিল না, খেলাপি ঋণ বাড়তেই থেকেছে। বর্তমানে তাদের দায়ের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি, যার বড় অংশই শুধু এই নয়টির ঘরে।


কেন এমন সিদ্ধান্ত?

ব্যাংকের মতোই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও জনগণের আমানত নিয়ে কাজ করে। নিয়মতান্ত্রিকতা, সুশাসন আর স্বচ্ছতা না থাকলে এমন প্রতিষ্ঠানে আস্থা ধরে রাখা অসম্ভব।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, এই ৯টি প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কাঠামো এতটাই ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে যে, এগুলো চালু রাখা মানে জনগণের আরও টাকা ঝুঁকির মুখে ফেলা।

এ কারণেই ফাইন্যান্স কোম্পানি আইন ২০২৩ অনুসারে লাইসেন্স বাতিল ও অবসায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।


অমানতকারীদের অর্থ ফেরত পাবেন কিভাবে?

এটাই এখন সবার সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

  • লিকুইডেশন প্রক্রিয়া: প্রতিষ্ঠানের সম্পদ, জমি-বাড়ি, বন্ধক রাখা সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা ফেরত আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
  • খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধার: যেসব ঋণ এখনো আদায় হয়নি, সেগুলো ফেরত আনার চেষ্টা চলবে।
  • সরকারি সহায়তা: বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যেই জানিয়েছে, প্রয়োজনে সরকারের কাছ থেকে বিশেষ তহবিল নেওয়া হবে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রাথমিকভাবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা লাগতে পারে।

অবশ্যই প্রশ্ন থেকে যায়—প্রক্রিয়া কতটা সময়সাপেক্ষ হবে? কারা আগে টাকা ফেরত পাবেন? এ ব্যাপারে এখনো পরিষ্কার কোনো রোডম্যাপ আসেনি।


অন্য প্রতিষ্ঠানের চিত্র কী বলছে?

সব প্রতিষ্ঠানই যে খারাপ, তা নয়। বাংলাদেশে এখনো প্রায় ১৫টি ব্যাংক-বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে, যেগুলো তুলনামূলক ভালো অবস্থায় আছে। তাদের ঋণের মধ্যে খেলাপি হার মাত্র ৭ শতাংশের মতো।
এটি প্রমাণ করে—যদি সুশাসন আর নিয়ন্ত্রণ থাকে, তবে এই খাতে এখনো আস্থা রাখা যায়।


মানুষের স্বপ্ন ভাঙা ও আশার আলো

সঞ্চয় মানেই মানুষের ভবিষ্যতের স্বপ্ন। সন্তানদের পড়াশোনা, বাড়ি বানানো, চিকিৎসা—সবকিছুতেই ভরসা থাকে এই টাকার ওপর।
যারা এই ৯ প্রতিষ্ঠানে টাকা রেখেছেন, তাদের স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে রূপ নিয়েছে। দিনের পর দিন লাইনে দাঁড়িয়ে ঘুরে বেড়ালেও অনেকেই তাদের আমানত ফেরত পাননি।

তাদের সেই দুশ্চিন্তা দূর করার দায়িত্ব এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের।


বিশ্লেষকদের পরামর্শ

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন—

  • অবসায়নের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই আমানতকারীদের টাকা ফেরতের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রকাশ করা উচিত।
  • ক্ষুদ্র আমানতকারীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টাকা ফেরত দেওয়া জরুরি।
  • ভবিষ্যতে যাতে এমন দুরবস্থা আর না হয়, সেজন্য তদারকি জোরদার করা দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এই সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে কঠিন, তবে সময়োপযোগী। অনিয়মের বোঝায় ভারাক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর টেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এখন মূল দায়িত্ব হলো—জনগণের সঞ্চয় নিরাপদে ফেরত দেওয়া। কারণ, অর্থনীতি কেবল সংখ্যার খেলা নয়; এর সাথে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবনের স্বপ্ন, নিরাপত্তা আর বিশ্বাস।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *