ভূমিকা
যশোরের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের মানুষের এক চিরচেনা সমস্যা—জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে অভয়নগর উপজেলার পায়রা ইউনিয়নসহ ভবদহ অঞ্চলের মানুষের জীবনে জলাবদ্ধতা যেন নিত্যসঙ্গী। বছরের পর বছর এ অঞ্চলের মানুষ পানির সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। মৌলিক চাহিদার প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্ভোগ যেন নিত্যদিনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বর্ষা এলেই ঘরবাড়ি ছেড়ে সড়কে আশ্রয় নিতে হয় হাজারো পরিবারকে। উঠান, রাস্তা, খেলার মাঠ থেকে শুরু করে বিদ্যালয় পর্যন্ত পানির নিচে তলিয়ে যায়। অথচ সমাধানের আশ্বাস মিললেও এ সমস্যার স্থায়ী কোনো সমাধান আজও হয়নি।
মানুষের নিত্যদিনের সংগ্রাম
ভবদহের মিজানুর প্রতিদিন সকালে দ্বাদশ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ে সুমাইয়াকে নিয়ে নৌকায় বের হন। কাজের জায়গায় মেয়েকে নামিয়ে আবার সেই নৌকাতেই মেয়ে বাড়ি ফেরে। শুধু মিজানুর নন, মনিরামপুর, কেশবপুর বা অভয়নগরের হাজারো পরিবার একই বাস্তবতার মুখোমুখি।
শিক্ষার্থীরা নৌকা কিংবা বাঁশের সাঁকো দিয়ে বিদ্যালয়ে আসে যায়। ফারজানা নামের এক কিশোরী প্রতিদিন পানিতে ভিজে সাইকেল চালিয়ে স্কুলে যায়। কিন্তু ঘরে ঢুকতে হয় মায়ের সহায়তায় বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে।
শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান—সবকিছুতেই পানির সঙ্গে যুদ্ধ এ অঞ্চলের মানুষের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। অনেক পরিবার ভিটেমাটি ছেড়ে মহাসড়কের ওপর ঘর বেঁধে বছরের পর বছর বেঁচে আছে।
নদী ও খালের নাব্যতা হারানো
যশোর জেলার অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর, ডুমুরিয়া ও ফুলতলার কিছু অংশ মিলে গঠিত ভবদহ অঞ্চলের নদী ও খাল একসময় ছিল প্রাণচঞ্চল। মুক্তেশ্বরী, শ্রীহরি, টেকা নদী এ অঞ্চলের প্রধান নদী হলেও বর্তমানে এসব নদী নাব্যতা হারিয়ে ফেলেছে।
স্থানীয়রা বলছেন, পলি জমে নদী ও খাল ভরাট হয়ে গেছে। পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষায় পানি জমে থাকে। গ্রীষ্ম এলেও পানি শুকাতে সময় লাগে, ফলে বছরের বেশিরভাগ সময়ই মানুষ পানির কষ্ট ভোগ করে।
স্লুইসগেটের ব্যর্থতা
জলাবদ্ধতা দূর করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬১ সালে ভবদহ অঞ্চলে পাঁচটি স্থানে ৪৪টি স্লুইসগেট নির্মাণ করে। কিন্তু বর্তমানে ২১টি কপাটের মধ্যে ১৮টি পলি জমে বন্ধ হয়ে আছে। এর ফলে পানি নিষ্কাশনের পথ পুরোপুরি অচল হয়ে পড়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, “ষাটের দশকে নির্মিত জলকপাটগুলোর জীবনকাল অনেক আগেই শেষ হয়েছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় ধীরে ধীরে গেটগুলো খোলা হচ্ছে। ভুক্তভোগী মানুষের মতামত ও কারিগরি বিষয় একত্রিত করে জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা এগোচ্ছি।”
মহাসড়কে জীবনের আশ্রয়
জলাবদ্ধতার কারণে অনেক পরিবারকে বসবাস করতে হচ্ছে মহাসড়কে। আগস্টের শেষ দিকেও কেশবপুর উপজেলার অন্তত সাড়ে ৩০০ পরিবার যশোর-সাতক্ষিরা মহাসড়কে ঘর বেঁধে বসবাস করছে। তাদের কাছে ঘর মানেই মহাসড়কের ওপর টিন বা পলিথিনের ছাউনি।
এ পরিবারগুলোর জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট শিশুদের পড়াশোনা, নারীদের দৈনন্দিন কাজ, অসুস্থদের চিকিৎসা—সবকিছুই পানির কারণে ব্যাহত হচ্ছে।
সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
জলাবদ্ধতার কারণে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। জমি বছরের অধিকাংশ সময় পানির নিচে থাকায় ফসল উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফলে কৃষকরা জীবিকা হারাচ্ছেন।
অন্যদিকে, স্থানীয় অর্থনীতিও চরম ক্ষতির মুখে পড়েছে। বাজারগুলোতে স্বাভাবিক বেচাকেনা ব্যাহত হয়। মানুষকে বেশি খরচ করে নৌকায় যাতায়াত করতে হয়। ফলে আর্থসামাজিক দুরবস্থা বাড়ছে।
স্থায়ী সমাধানের দাবি
ভবদহ অঞ্চলের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়ে আসছে। তারা বলছেন, স্লুইসগেটের আধুনিকায়ন, খাল পুনঃখনন এবং নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনাই হতে পারে সমস্যার স্থায়ী সমাধান।
সরকার ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে যদি নিয়মিত খাল খনন ও নদীর পলি অপসারণ করা যায়, তবে এ অঞ্চলের মানুষ জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তি পাবে।
উপসংহার
ভবদহ শুধু একটি ভৌগোলিক এলাকা নয়, এটি যশোরবাসীর জন্য আজ এক দুঃখের নাম। দশকের পর দশক ধরে মানুষ পানির সঙ্গে লড়াই করে যাচ্ছে। অথচ সমস্যার মূল সমাধান এখনও হয়নি।
মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিতে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যকর বাস্তবায়ন। ভবদহবাসীর দুঃখ ঘোচাতে রাষ্ট্র ও স্থানীয় প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে।
