অনলাইন ডেস্ক:
ঢাকা, ৯ অক্টোবর ২০২৫:
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত সমন্বয় করে কমিশন আগামী দুই এক দিনের মধ্যে সরকারকে পরামর্শ দেবে।
বুধবার রাতে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমির দোয়েল হলে অনুষ্ঠিত “জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫”-এর আলোচনার তৃতীয় পর্যায়ের পঞ্চম দিনের বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন।
জুলাই সনদ প্রণয়নের অগ্রগতি
ড. আলী রীয়াজ বলেন, “আগামী ১৫ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। এর আগে জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজনের পরিকল্পনা করা হয়েছে।”
তিনি জানান, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইতিমধ্যে সনদ স্বাক্ষরে রাজি হয়েছে, এবং কমিশন চায় এই ঐতিহাসিক দলিলটি মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই স্বাক্ষরিত হোক।
তিনি আরও বলেন, “শুধু সনদ স্বাক্ষর নয়, একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনও প্রকাশ করা হবে। এতে থাকবে জুলাই সনদ প্রণয়নের প্রক্রিয়া, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মতামত ও জমাকৃত প্রস্তাব।”
কমিশন আশা করছে, ১৮ থেকে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা যাবে।
গণভোট আয়োজনের সিদ্ধান্ত
কমিশনের সাম্প্রতিক ৫ অক্টোবরের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত হয়,
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫ বাস্তবায়নে গণভোট আয়োজন করা হবে।’
ড. আলী রীয়াজ জানান, বুধবারের বৈঠকে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল গণভোট কখন ও কীভাবে হবে, সেটি নির্ধারণ করা।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, গণভোট আয়োজনের জন্য একটি সরকারি আদেশ (Executive Order) জারি করা হবে।
গণভোটে দুইটি ভাগ থাকবে —
প্রথম ভাগে থাকবে জাতীয় ঐকমত্যের বিষয়গুলো,
দ্বিতীয় ভাগে থাকবে “নোট অব ডিসেন্ট” অর্থাৎ ভিন্নমতের প্রস্তাবগুলো।
গণভোট অনুমোদন পেলে, সেই ফলাফলের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধনের কাজ শুরু হবে।
এরপর নির্বাচন হবে সংবিধান সংস্কার পরিষদ ও ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ গঠনের জন্য।
রাজনৈতিক দলের অবস্থান
ড. আলী রীয়াজ বলেন, কিছু দল প্রস্তাব দিয়েছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের,
আবার কিছু দল বলেছে নির্বাচনের আগেই আলাদা তারিখে গণভোট করা উচিত।
তিনি বলেন, “আমরা দেখছি, সব দলের মধ্যে একধরনের ঐকমত্য তৈরি হয়েছে—
ত্রয়োদশ সংসদকে ‘জুলাই সনদ ২০২৫’ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা দিতে হবে।”
দল ও জোটগুলো চায়, কমিশন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের মতামত একত্র করে সরকারকে চূড়ান্ত পরামর্শ দিক।
কমিশনের দায়িত্ব ও অগ্রগতি
কমিশনের সহ-সভাপতি ড. রীয়াজ জানান,
“আমরা এখন প্রক্রিয়ার একদম শেষ পর্যায়ে আছি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
তিনি আরও বলেন, “প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনায় আমরা এগিয়ে এসেছি।
তিনি সব সময় কমিশনের কাজ পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং সরকারের সঙ্গে সমন্বয় রক্ষা করেছেন।”
ড. রীয়াজ মনে করেন, জুলাই সনদ শুধু একটি রাজনৈতিক দলিল নয়—
এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি নতুন যুগের সূচনা।
জুলাই জাতীয় সনদ: প্রেক্ষাপট
“জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫” হচ্ছে বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল,
যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন, সুশাসন, নির্বাচনী সংস্কার ও ক্ষমতার ভারসাম্য নিশ্চিতের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
এই সনদের প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয় জুলাই মাসে, দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে।
এর লক্ষ্য—দীর্ঘ রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সংঘাতের পর একটি স্থায়ী রাজনৈতিক ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করা।
সামনের সময়সূচি
- ১৫ অক্টোবর: কমিশনের মেয়াদ শেষ
- ১৫ অক্টোবরের মধ্যেই: সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান
- ১৮–১৯ অক্টোবর: পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ
- পরবর্তী ধাপ: গণভোট আয়োজনের তারিখ নির্ধারণ ও সংবিধান সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু
কমিশনের প্রধান উপদেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা
ড. আলী রীয়াজ বলেন,
“কমিশনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করেছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি নিয়মিতভাবে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন, কাজের অগ্রগতি জেনেছেন এবং সরকারের করণীয় দিক নির্দেশ করেছেন।”
তিনি আরও বলেন,
“আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে গত বছর ফ্যাসিবাদের পতন ঘটানো।
এ ঐক্য অক্ষুণ্ন রাখতে হবে। প্রতিযোগিতা হোক, কিন্তু ঐক্য নষ্ট করা যাবে না।”
বৈঠকে অংশ নেওয়া সদস্যরা
তৃতীয় পর্যায়ের পঞ্চম দিনের বৈঠকে অংশ নেন—
বিএনপি, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টিসহ প্রায় ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা।
সভায় সভাপতিত্ব করেন সহ-সভাপতি ড. আলী রীয়াজ।
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্যরা—
ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান,
ড. মো. আইয়ুব মিয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার।
পরিশেষে
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের এই উদ্যোগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রাজনৈতিক মতভেদ থাকা সত্ত্বেও, দলগুলো এখন এক ছাতার নিচে এসে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক কাঠামো নিয়ে আলোচনা করছে —
এটাই সবচেয়ে বড় অর্জন।
কমিশনের পরামর্শ যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে এটি বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে আরও শক্তিশালী ভিত্তি দেবে।
