অনলাইন ডেস্ক:
নিউইয়র্ক, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫:
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনের ফাঁকে শুক্রবার এক বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়, যখন বিশ্বের প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ও তাঁর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে পূর্ণ সমর্থন জানান। নিউইয়র্কে অধ্যাপক ইউনূসের হোটেল স্যুইটে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকটি ছিল ইতিহাসের এক অনন্য দৃশ্য, যেখানে সাবেক রাষ্ট্রপ্রধান, সরকারপ্রধান, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি এবং মানবাধিকার সংগঠনের নেতারা একত্রিত হন বাংলাদেশকে সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি জানাতে।
বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য
বৈঠকের প্রধান লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা। বিশ্বনেতারা কেবল সমর্থনই জানাননি, বরং প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাংলাদেশকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও সহায়তা দেওয়ার। তাঁদের বক্তব্যে প্রতিফলিত হয়েছে এক গভীর আস্থা—অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্নীতি, কু-শাসন ও দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে সক্ষম হবে।
বৈঠকে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা
বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বের নামকরা কয়েকজন সাবেক রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান, যেমন:
- লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ভাইরা ভিকে-ফ্রেইবারগা, যিনি নিজামি গঞ্জাভি আন্তর্জাতিক কেন্দ্রের (এনজিআইসি) সহ-সভাপতি হিসেবে প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দেন।
- স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বরুত পাহোর
- সার্বিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট বোরিস তাদিচ
- লাটভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট এগিলস লেভিটস
- ইউরোপীয় কাউন্সিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও বেলজিয়ামের সাবেক প্রধানমন্ত্রী চার্লস মিশেল
- গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জর্জ পাপান্দ্রেউ
- বুলগেরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট রোসেন প্লেভনেলিভ ও পেতার স্তোইয়ানোভ
- ক্রোয়েশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইভো যোসিপোভিচ
- বসনিয়া-হার্জেগোভিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট ম্লাদেন ইভানিচ
- মরিশাসের সাবেক প্রেসিডেন্ট আমিনা গুরিব-ফাকিম
এছাড়া উপস্থিত ছিলেন কমনওয়েলথের সাবেক মহাসচিব, জর্জিয়ার সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চারজন সাবেক সভাপতি, একাধিক সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিশ্বব্যাংকের সাবেক সহ-সভাপতি ও এনজিআইসি’র সহ-সভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন, মানবাধিকার সংগঠন রবার্ট এফ. কেনেডি হিউম্যান রাইটস-এর প্রেসিডেন্ট কেরি কেনেডি, আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এবং জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি-এর প্রতিনিধি।
নেতৃবৃন্দের বার্তা
বিশ্বনেতারা অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্ব, দারিদ্র্য দূরীকরণে তাঁর আজীবন অবদান এবং সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকার প্রশংসা করেন। তাঁরা এক কণ্ঠে বলেন:
“আমরা আপনাকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে সমর্থন জানাতে এসেছি। আমরা আপনার পাশে আছি।”
তাঁরা আরও উল্লেখ করেন, যদিও বাংলাদেশ গত ১৬ বছরের দুর্নীতি ও কু-শাসনের ধাক্কা সামলাচ্ছে, তবুও নতুন সরকারের উদ্যোগ দেশটিকে অগ্রগতির নতুন পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
মানবাধিকার ও অগ্রগতির স্বীকৃতি
মানবাধিকার কর্মী কেরি কেনেডি বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, “মানবাধিকারের ক্ষেত্রে আপনাদের অর্জন অসাধারণ।”
অন্যদিকে জর্জটাউন ইনস্টিটিউট ফর উইমেন, পিস অ্যান্ড সিকিউরিটির নির্বাহী পরিচালক মেলান ভারভিয়ার ঘোষণা দেন যে, তাঁদের প্রতিষ্ঠান শিগগিরই বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন জানাবে।
এনজিআইসি’র সহ-সভাপতি ইসমাইল সেরাগেলদিন বলেন, “আপনাদের প্রয়োজন হলে আমরা আছি।”
অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিক্রিয়া
অধ্যাপক ইউনূস বৈঠকে পাওয়া এই অভূতপূর্ব সমর্থনে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন:
“এটি একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আপনাদের একসঙ্গে আমাদের সমর্থনে দাঁড়ানো সত্যিই অবিশ্বাস্য। আমি একেবারেই মুগ্ধ।”
তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে তুলনা করেন একটি ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে:
“দেশটি গত ১৬ বছর ধরে একটি ভূমিকম্পের মধ্যে ছিল। এর মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৯।”
অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, সীমিত সম্পদের কারণে জনগণের প্রত্যাশা পূরণই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। “মানুষ তাৎক্ষণিক পরিবর্তন দেখতে চায়। তবে তরুণ প্রজন্ম একটি নতুন বাংলাদেশ খুঁজছে। তাদের স্বপ্ন পূরণ করাই আমাদের লক্ষ্য।”
আগামীর প্রত্যাশা
অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সমর্থন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন:
“আমাদের দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। আপনাদের পরামর্শ, সহযোগিতা ও নৈতিক শক্তি আমাদের জন্য অমূল্য।”
সভায় এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন।
এই বৈঠক কেবল একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের প্রতি আস্থার প্রতীক। বিশ্বনেতাদের এই সমর্থন বাংলাদেশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং সামাজিক উন্নয়নের পথে আরও দৃঢ় করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
