দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে আমদানি নির্ভরতা: বাড়ছে ব্যয়, কমছে দেশীয় উৎপাদন

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি ও বিপিডিবির উৎপাদন সক্ষমতার সংকটের চিত্র। দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়ছে আমদানিকৃত বিদ্যুতের ব্যবহার, বিপিডিবির উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও গ্যাস সংকটে কেন্দ্রগুলো অচল।

অনলাইন ডেস্ক:

বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে এক অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে এখন সবচেয়ে বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে আমদানিকৃত বিদ্যুতের ওপর। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) হাতে বিপুল উৎপাদন সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও স্থানীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। এর ফলে গ্রিডে আমদানি বিদ্যুতের অংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ পর্যন্ত।

বিদ্যুৎ আমদানির বর্তমান চিত্র

বাংলাদেশ প্রতিবেশী দেশ ভারত ও নেপালের সঙ্গে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের আওতায় মোট ২,৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি করেছে। এর মধ্যে ভারতের আদানি গ্রুপের সঙ্গে ১,৬০০ মেগাওয়াটের চুক্তি থাকলেও গড়ে প্রায় ১,২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাচ্ছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি সরকারি জি-টু-জি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে আরও প্রায় ১,০০০ মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে প্রায় ৩৮ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ প্রতিদিন গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে।

এই বিপুল আমদানি নির্ভরতার কারণে সরকারের বিদ্যুৎ বিলের একটি বড় অংশ বিদেশে গুনতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু না থাকলেও ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাবদ বিপিডিবিকে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হচ্ছে, যা বিদ্যুৎ খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাড়াচ্ছে।

দেশীয় উৎপাদনের অবস্থা

বিপিডিবির মোট উৎপাদন সক্ষমতা ৬,১১৪ মেগাওয়াট। কিন্তু ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিপিডিবির কাছ থেকে কেনা হয়েছে মোট ব্যবহারের মাত্র সাড়ে ১৬ শতাংশ বিদ্যুৎ। ফলে সংস্থাটির কেন্দ্রগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর নেমে এসেছে ৩০ শতাংশের নিচে।

প্লান্ট ফ্যাক্টর হলো একটি সূচক, যা দিয়ে বোঝা যায় বিদ্যুৎকেন্দ্র কতটা সক্ষমতা নিয়ে চলছে। সাধারণত একটি কেন্দ্র ৮০ শতাংশ ফ্যাক্টরে চালানোর পরিকল্পনা থাকে। অথচ বিপিডিবির বাস্তব চিত্রে এ হার নেমে এসেছে ১৮-৩০ শতাংশে।

আর্থিক চাপ

২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিপিডিবির নিজস্ব অংশ মাত্র ১৩ হাজার ৪০২ কোটি টাকা। অপরদিকে আইপিপি, ভাড়া ভিত্তিক কেন্দ্র এবং ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে খরচ হয়েছে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

ফলে বিপিডিবির আর্থিক অবস্থা দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। অনেক কেন্দ্র বন্ধ থাকলেও জনবল ও রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল ব্যয় বহন করতে হচ্ছে সংস্থাটিকে।

গ্যাস সংকট ও কেন্দ্র বন্ধ থাকার কারণ

দেশীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই গ্যাস ও তেলভিত্তিক। গ্যাস সংকটের কারণে অনেক কেন্দ্র চালু রাখা সম্ভব হচ্ছে না। তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোও বছরের বেশির ভাগ সময় বন্ধ থাকে।

  • গ্যাসভিত্তিক ২১টি কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা: ৪,২৭৮ মেগাওয়াট (প্লান্ট ফ্যাক্টর মাত্র ৩২%)
  • সৌর, জল ও বায়ুবিদ্যুৎ কেন্দ্র: ২৪২ মেগাওয়াট (জলবিদ্যুৎ ৪১%, সৌর ১৩%, বায়ু ০%)
  • ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্র: ৭৪২ মেগাওয়াট (মাত্র ১৭% ফ্যাক্টরে চালু)
  • ডিজেল কেন্দ্র: পুরোপুরি বন্ধ

বিশেষজ্ঞদের মত

বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিপিডিবির তালিকায় থাকা অনেক কেন্দ্র এখন কার্যত খাতা-কলমে বিদ্যমান। বাস্তবে এগুলোর বেশির ভাগই অচল, পুরনো এবং অদক্ষ। তাই অদক্ষ কেন্দ্রগুলো ফেজ আউট করা এখন সময়ের দাবি।

তারা বলেন, স্থানীয় সক্ষমতা ব্যবহার না করে বিদেশি বিদ্যুতের ওপর নির্ভর করলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। পাশাপাশি আমদানি নির্ভরতা বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি হবে।

বিপিডিবির বক্তব্য

বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, গ্যাস সরবরাহ সংকটই মূলত দেশীয় উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। ঘোড়াশাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে বড় সক্ষমতা থাকলেও গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সেটি পুরোপুরি চালু রাখা যাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, পুরনো কেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে অবসরে যাবে। তবে খরচ কমাতে এবং কার্যকর উৎপাদন নিশ্চিত করতে বিপিডিবি বিকল্প পরিকল্পনায় কাজ করছে।

ভবিষ্যৎ করণীয়

১. গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধি: গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বাড়াতে দ্রুত গ্যাস সংকট নিরসন করা প্রয়োজন।
2. নবায়নযোগ্য জ্বালানি: সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য খাতকে এগিয়ে নিতে হবে।
3. অদক্ষ কেন্দ্র বাদ দেওয়া: পুরনো ও অদক্ষ কেন্দ্রগুলো তালিকা থেকে বাদ দিয়ে প্রকৃত সক্ষমতা নিরূপণ জরুরি।
4. বিদ্যুৎ আমদানি নির্ভরতা কমানো: দীর্ঘমেয়াদে স্বনির্ভরতার দিকে যেতে হবে।

বিদ্যুৎ বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। কিন্তু এই খাতে অতিরিক্ত আমদানি নির্ভরতা দেশের অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সঠিক পরিকল্পনা ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশীয় সক্ষমতা কাজে লাগাতে পারলেই এ খাতে টেকসই সমাধান পাওয়া সম্ভব।

সূত্র : এফএনএস নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *