অনলাইন ডেস্ক:
বাংলা ভাষা আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ, কবি, প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্রবিশেষজ্ঞ আহমদ রফিকের প্রয়াণে জাতির হৃদয়ে নেমে এসেছে গভীর শোক। বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর ২০২৫) রাত ১০টা ১২ মিনিটে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শোকবার্তায় তিনি আহমদ রফিকের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার অবদানকে স্মরণ করে বলেন, এই প্রয়াণ জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি।
আহমদ রফিক: এক জীবন্ত ইতিহাস
আহমদ রফিক ১৯২৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার শাহবাজপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং ছাত্রদের সংগঠিত করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। তাঁর নাম কেবল একজন ভাষাসৈনিকের সঙ্গেই জড়িয়ে নেই, বরং একজন চিন্তাবিদ, গবেষক এবং সাহিত্যিক হিসেবেও তিনি অমর।
সাহিত্য ও গবেষণার জগতে তিনি ছিলেন সমানভাবে সমৃদ্ধ। ১৯৫৮ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম বই। তারপর শতাধিক বই রচনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন।
রবীন্দ্রচর্চায় অবদান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন, সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে আহমদ রফিক ছিলেন একনিষ্ঠ গবেষক। দুই বাংলার রবীন্দ্রভক্তদের কাছে তিনি বিশেষভাবে সম্মানিত। কলকাতার টেগর রিসার্চ ইনস্টিটিউট তাঁকে ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধি প্রদান করে, যা তাঁর বিদগ্ধতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচিত।
প্রধান উপদেষ্টার শোকবার্তা
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শোকবার্তায় বলেন:
“আহমদ রফিক ছিলেন ভাষা আন্দোলনের এক অগ্রগণ্য সাক্ষী ও সংগ্রামী কণ্ঠস্বর। একই সঙ্গে তিনি ছিলেন একজন অনন্য কবি, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও রবীন্দ্রতত্ত্বচর্চার দিশারি। শতাধিক গ্রন্থ রচনা ও সম্পাদনার মাধ্যমে তিনি বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন।”
তিনি আরও বলেন:
“দেশের সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার জগতে আহমদ রফিকের প্রয়াণ এক অপূরণীয় ক্ষতি। দৃষ্টিশক্তি ও শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি শেষ দিন পর্যন্ত জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে গেছেন। আহমদ রফিকের জীবন ও কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। জাতি কৃতজ্ঞচিত্তে তাকে স্মরণ করবে।”
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
আহমদ রফিক তাঁর সাহিত্য ও গবেষণার জন্য পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা।
- একুশে পদক
- বাংলা একাডেমি পুরস্কার
- রবীন্দ্র সাহিত্য পুরস্কার
- আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার স্বীকৃতি
ব্যক্তিজীবনের শেষ অধ্যায়
২০০৬ সালে স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি একাই বসবাস করতেন ঢাকার নিউ ইস্কাটনের গাউসনগরে। বয়সের ভারে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, পরে নানা শারীরিক জটিলতায় আক্রান্ত হন। মৃত্যুর আগে তিনি ডায়াবেটিস, কিডনি জটিলতা, আলঝেইমারস ডিজিজ ও পার্কিনসনসহ নানা রোগে ভুগছিলেন।
জাতির ক্ষতি
আহমদ রফিক কেবল একজন লেখক বা গবেষক নন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। তাঁর প্রয়াণে জাতি হারালো এক অনন্য বুদ্ধিজীবী ও সাহসী কণ্ঠস্বরকে। তাঁর রচিত গ্রন্থ, প্রবন্ধ ও গবেষণা আগামী প্রজন্মকে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক চেতনার পথ দেখাবে।
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের মৃত্যুতে জাতি শোকাহত। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের শোকবার্তায় যেমন উঠে এসেছে—তিনি ছিলেন এক আলোকবর্তিকা, যিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মুক্তচিন্তা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির আলো ছড়িয়েছেন। তাঁর অবদান প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বাঙালির চেতনায় অমর হয়ে থাকবে।
