অনলাইন ডেস্ক:
নিউইয়র্ক, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে নিউইয়র্কে আয়োজিত থেয়ারওয়ার্ল্ডের বার্ষিক উচ্চপর্যায়ের গ্লোবাল এডুকেশন ডিনারে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে দেওয়া হয়েছে “আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড”। শিক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাঁর অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ এই মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার প্রদান করা হয়।
সোমবার নিউইয়র্কের এক অভিজাত হোটেলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা সংকট মোকাবিলা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যকে সামনে রেখে অধ্যাপক ইউনূসের আজীবন প্রতিশ্রুতি বিশেষভাবে প্রশংসিত হয়।
অনুষ্ঠানের আয়োজক ও বৈশ্বিক নেতৃত্বের উপস্থিতি
শিশুদের জন্য নিবেদিত আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা থেয়ারওয়ার্ল্ড শিক্ষা সংকট নিরসন এবং শিশুদের সৃজনশীল বিকাশে কাজ করছে বহু বছর ধরে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিক্ষা বিষয়ক বিশেষ দূত ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী গর্ডন ব্রাউন এবং থেয়ারওয়ার্ল্ডের চেয়ার ও গ্লোবাল বিজনেস কোয়ালিশন ফর এডুকেশনের নির্বাহী চেয়ার সারা ব্রাউন।
শিক্ষার রূপান্তরমূলক শক্তিকে কেন্দ্র করে এই আয়োজন বিশ্বনেতাদের মিলনমেলায় পরিণত হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, উন্নয়নকর্মী এবং মানবাধিকার সংগঠনের প্রতিনিধিরা।
গর্ডন ব্রাউনের বক্তব্য : ইউনূস বিশ্বে অনন্য
অধ্যাপক ইউনূসকে পুরস্কার প্রদানের সময় গর্ডন ব্রাউন বলেন, “গত পঞ্চাশ বছরে বেসরকারি খাতে এমন কোনো প্রকল্প নেই যা দারিদ্র্যমুক্তিতে গ্রামীণ ব্যাংকের মতো কার্যকর ভূমিকা রেখেছে। অধ্যাপক ইউনূস কেবল বাংলাদেশ নয়, বরং পুরো বিশ্বের জন্য এক পথপ্রদর্শক।”
তিনি আরও যোগ করেন, মাইক্রোক্রেডিট ও শিক্ষা সংযুক্ত করে ইউনূস এমন একটি মডেল তৈরি করেছেন যা টেকসই উন্নয়ন ও মানবকল্যাণে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ইউনূসের স্বপ্ন : ঋণও একটি মানবাধিকার
পুরস্কার গ্রহণকালে অধ্যাপক ইউনূস আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলেন, “খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো ঋণও একটি মৌলিক মানবাধিকার। যদি আর্থিক ব্যবস্থার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত হয়, তবে পৃথিবীতে কেউ আর গরিব থাকবে না।”
তিনি ব্যাখ্যা করেন, মাইক্রোক্রেডিট কেবল ঋণ নয়, বরং এটি নারীর ক্ষমতায়ন, সন্তানের শিক্ষা এবং পরিবারের আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের পথ খুলে দিয়েছে।
নারীর ক্ষমতায়ন ও শিক্ষার প্রসার
অধ্যাপক ইউনূস তাঁর বক্তৃতায় বলেন, মাইক্রোক্রেডিটের মাধ্যমে বহু নারী তাদের পরিবারকে দারিদ্র্য থেকে মুক্ত করেছেন। একইসঙ্গে তারা সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি বলেন, “আমি মাইক্রোক্রেডিটের প্যাকেজে শিক্ষাকে যুক্ত করেছি, কারণ শিক্ষা ছাড়া দারিদ্র্যমুক্তি কখনোই স্থায়ী হয় না।”
শিক্ষার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “ছোটবেলা থেকেই শিশুদের সৃজনশীলতা ও উদ্যোক্তা মানসিকতা গড়ে তোলার শিক্ষা দেওয়া উচিত।”
তিনি উল্লেখ করেন, একজন শিশুর শেখা উচিত কিভাবে উদ্যোক্তা হওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এমন শিক্ষার কেন্দ্র হতে হবে যেখানে ব্যবসাকে মানবকল্যাণের শক্তি হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
তাঁর মতে, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়া উচিত এমন জায়গা যেখানে মানব সমস্যার সমাধান শুধু উৎসাহিতই নয়, প্রত্যাশিতও হবে।
মানবতার জন্য ব্যবসার শক্তি
অধ্যাপক ইউনূস দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, “মানবসমাজের সব সমস্যারই ব্যবসায়িক সমাধান সম্ভব। ব্যবসাকে মানবকল্যাণের উদ্দেশ্যে ব্যবহার করলে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও বৈষম্য দূর হবে।”
তিনি সামাজিক ব্যবসার ধারণা ব্যাখ্যা করে বলেন, মুনাফা নয় বরং সমাজের সমস্যার সমাধানই হবে এ ব্যবসার মূল উদ্দেশ্য।
সহ-সম্মাননা : জাতিসংঘের শরণার্থী হাইকমিশনার
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ইউনূসের পাশাপাশি জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপো গ্রান্ডিকেও সম্মাননা দেওয়া হয়। তবে দারিদ্র্য বিমোচনে দীর্ঘদিনের মাইক্রোক্রেডিট কার্যক্রম এবং শিক্ষাকে এর মূল কেন্দ্রে অন্তর্ভুক্ত করার কারণে ইউনূসের স্বীকৃতি বিশেষ গুরুত্ব পায়।
এক নতুন দিগন্ত
“আনলক বিগ চেঞ্জ অ্যাওয়ার্ড” কেবল একটি পুরস্কার নয়, এটি বিশ্বকে জানিয়ে দেয় যে একজন মানুষের নেতৃত্ব, দৃষ্টিভঙ্গি ও দৃঢ় প্রতিশ্রুতি পুরো মানবজাতির ভবিষ্যৎকে বদলে দিতে পারে।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের এই সম্মাননা বাংলাদেশের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি বৈশ্বিক দারিদ্র্য বিমোচন ও শিক্ষার বিস্তারে নতুন অনুপ্রেরণা।
তথ্য সূত্র: বাসস
