শহীদ মিনারে ফরিদা পারভীনকে শেষ শ্রদ্ধা, কুষ্টিয়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত

কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বরেণ্য লোকসংগীতশিল্পী ফরিদা পারভীনের মরদেহে সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা লোকসংগীতের মহারানী ফরিদা পারভীনকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে মানুষের ঢল, ছবি সংগ্রহীত

অনলাইন ডেস্ক:

সংগীতাঙ্গনে শোকের ছায়া

বাংলাদেশের লোকসংগীতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র নিভে গেল। ফরিদা পারভীন, যিনি তার কণ্ঠে লালনগীতি ও লোকসংগীতকে পৌঁছে দিয়েছিলেন ঘরে ঘরে, তিনি আর নেই। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর ইউনিভার্সেল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।

তার মৃত্যুতে দেশজুড়ে নেমে এসেছে শোকের ছায়া। শিল্পী, সাহিত্যিক, কলাকুশলী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সবাই হারালেন প্রিয়জনকে।


শেষ যাত্রার আনুষ্ঠানিকতা

রবিবার সকাল থেকেই শুরু হয় শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজন। সকাল ৯টায় রাজধানীর তেজকুনি পাড়া মসজিদে অনুষ্ঠিত হয় তার প্রথম নামাজে জানাজা। এরপর সকাল সাড়ে ১০টায় মরদেহ আনা হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

শহীদ মিনারে শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী, রাজনৈতিক নেতা ও সর্বস্তরের মানুষ তাকে শেষ শ্রদ্ধা জানান। দীর্ঘ সময় ধরে সেখানে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদে। সেখানে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় নামাজে জানাজা। পরে মরদেহ নেওয়া হয় শিল্পীর জন্মস্থান কুষ্টিয়ায়। সেখানকার পৌর কবরস্থানে মা-বাবার কবরের পাশে ফরিদা পারভীনকে দাফন করা হয়।


সংগীতে তার অবদান

ফরিদা পারভীন শুধু একজন শিল্পী নন, তিনি ছিলেন বাংলাদেশের লোকসংগীতের জীবন্ত প্রতীক। বিশেষ করে লালনগীতি পরিবেশনায় তার তুলনা ছিল না। “অচিন পাখি”, “খাঁচার ভেতর অচিন পাখি” বা “সত্য বল সুপথে চল”—এসব গান তার কণ্ঠে পেয়েছে নতুন জীবন।

তার গাওয়া গান শুধু মঞ্চে নয়, সাধারণ মানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছে। দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি দেশ-বিদেশে লালনের গান প্রচার করে গেছেন। তার গানে ফুটে উঠত সহজ-সরল জীবনের দার্শনিকতা, মানবপ্রেম ও আধ্যাত্মিকতার বার্তা।


সম্মাননা ও স্বীকৃতি

ফরিদা পারভীনের সংগীতজীবন ছিল সমৃদ্ধ। তিনি পেয়েছেন একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা।

  • একুশে পদক (১৯৮৭)
  • জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩)
  • বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের পুরস্কার

তার জীবনজুড়ে সংগীতই ছিল ধ্যান ও জপ। তিনি প্রমাণ করেছিলেন লোকসংগীত কেবল গ্রামীণ আঙিনার নয়, বরং তা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মঞ্চেও সমান মর্যাদার দাবিদার।


পরিবার ও ব্যক্তিজীবন

ফরিদা পারভীনের স্বামী ওস্তাদ গাজী আব্দুল হাকিম প্রখ্যাত বংশীবাদক। স্বামী-স্ত্রী দুজনই ছিলেন সংগীতের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। সংগীতচর্চা ও পরিবেশনায় একে অপরের অনুপ্রেরণা হয়ে থাকতেন।


শিল্পী সমাজের শোক

শিল্পী সমাজ মনে করছে, ফরিদা পারভীনের প্রয়াণে সংগীতাঙ্গনে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি হলো। তার কণ্ঠের মায়া, গানের আবেগ আর গভীরতার জায়গা পূরণ করা সহজ হবে না।

বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অনেকেই বলছেন, ফরিদা পারভীন ছিলেন দেশের লোকসংগীতের মহারানী। তিনি চলে গেলেও তার গান প্রজন্মের পর প্রজন্ম বেঁচে থাকবে।


সাধারণ মানুষের আবেগ

তার মৃত্যুতে কুষ্টিয়া ও আশপাশের মানুষ গভীর শোকে মুহ্যমান। সেখানে তার বাড়ি ও “অচিন পাখি” নামে সংগীত স্কুলে কান্নায় ভেঙে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও ভক্তরা।


লোকসংগীতের এই মহারানীকে বিদায় জানাল পুরো জাতি। শহীদ মিনারে লাখো মানুষের শ্রদ্ধা ও কুষ্টিয়ার মাটিতে চিরশয্যা—এই দুইয়ে শেষ হলো তার জীবনের অধ্যায়।

কিন্তু গান যে অমর, তা আবারও প্রমাণ করলেন ফরিদা পারভীন। তিনি চলে গেছেন, তবে তার গানে তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *