এনসিটিবির পরিবর্তে প্রাথমিকের বই ছাপাবে শিক্ষা অধিদপ্তর

বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যের বই, বিতরণকেন্দ্রে রাখা নতুন পাঠ্যবইয়ের স্তূপ প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপা ও বিতরণের দায়িত্ব নিচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, পরিবর্তিত হচ্ছে আইন, প্রতীকি ছবি

অনলাইন ডেস্ক:

আইনের সংশোধনী ও নতুন উদ্যোগ

অবশেষে দীর্ঘদিনের বিতর্ক ও আলোচনার পর প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবই ছাপার দায়িত্ব জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর পরিবর্তে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের হাতে দেওয়া হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১৮ সালের আইন সংশোধন করে এ প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের খসড়া অনুযায়ী, প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা, প্রকাশনা ও বিতরণ করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। অন্যদিকে এনসিটিবি কেবল শিক্ষাক্রম প্রণয়ন এবং মাধ্যমিক স্তরের বই বিতরণের কাজ করবে।


পেছনের ইতিহাস

বাংলাদেশে পাঠ্যবই প্রকাশনার দায়িত্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

  • ১৯৪৭ সালে গঠিত হয় পূর্ববঙ্গ স্কুল টেক্সটবুক কমিটি
  • ১৯৫৪ সালে আইন পাস করে গঠিত হয় স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড
  • ১৯৮৩ সালে স্কুল টেক্সটবুক বোর্ড ও জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্রকে একীভূত করে বর্তমান এনসিটিবি গঠন করা হয়।
  • ২০১০ সাল থেকে সরকার বছরের শুরুতেই শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই পৌঁছে দিচ্ছে

কিন্তু সময়মতো বই সরবরাহ না হওয়া, মান নিয়ে প্রশ্ন ও সমন্বয়হীনতার অভিযোগ বারবার উঠেছে এনসিটিবির বিরুদ্ধে।


কেন পরিবর্তন দরকার হলো?

প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের দাবি, প্রতি বছর বই ছাপায় দেরি, বিতরণে জটিলতা এবং গুণগত মানের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীরা সমস্যায় পড়ে। উদাহরণ হিসেবে এ বছর তিন মাস দেরি হয়েছে বই পৌঁছাতে, কারণ মন্ত্রণালয় শেষ মুহূর্তে শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়।

ফলে ২০২২ সাল থেকে আলাদাভাবে বই ছাপার উদ্যোগ নেয় প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগ। দীর্ঘ টানাপোড়েনের পর অবশেষে তা বাস্তব রূপ পাচ্ছে।


এনসিটিবির বক্তব্য

তবে এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতার কারণেই সংকট হয়নি। বরং মন্ত্রণালয়ের নীতিগত সিদ্ধান্তগুলোও দায়ী।

তাদের আশঙ্কা, আলাদাভাবে বই ছাপালে সমন্বয়হীনতা আরও বাড়বে। এনসিটিবির অভ্যন্তরে যেসব ব্যর্থতা ছিল, তা ব্যক্তি পর্যায়ে সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু পুরো প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করলে শিক্ষাক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি হবে।


নতুন আইনের মূল প্রস্তাব

খসড়া অনুযায়ী:

  • এনসিটিবি আইন ২০১৮-তে সংশোধনী আনা হবে।
  • প্রাথমিক শিক্ষাক্রম শাখার কর্মকর্তারা প্রেষণে আসবেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) থেকে।
  • প্রাক্-প্রাথমিক ও প্রাথমিক স্তরের বই ছাপা, প্রকাশনা ও বিতরণ করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর
  • শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ হবেন শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ বা নেপ-এর কর্মকর্তারা।
  • সচিব পদ বাদ দিয়ে পরিচালক পদ রাখা হবে।

২০২৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে এ নতুন কাঠামো কার্যকর হতে পারে।


বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তারিক মনজুর এ উদ্যোগকে “সম্পূর্ণ বাজে” বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, এনসিটিবিকে শক্তিশালী না করে দুর্বল করলে শিক্ষার সামগ্রিক ক্ষতি হবে।

তিনি বলেন—
“এনসিটিবির পূর্ণ সাংগঠনিক কাঠামো রয়েছে। পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ, বিতরণ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ও মান যাচাই সবকিছুই তারা করে থাকে। সমস্যা আছে, কিন্তু সক্ষমতা বাড়িয়ে তা সমাধান করা সম্ভব।”

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এ উদ্যোগ মূলত প্রতিষ্ঠানিক দ্বন্দ্ব থেকে এসেছে, সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে নয়।


সামনের চ্যালেঞ্জ

  • আগামী বছর প্রাথমিক স্তরের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ৮ কোটি ৪৯ লাখ বই
  • মাধ্যমিক স্তরের জন্য প্রয়োজন হবে প্রায় ২১ কোটি ৪০ লাখ বই
  • নভেম্বরের মধ্যে ছাপা শেষ করার লক্ষ্য থাকলেও শেষ মুহূর্তের সিদ্ধান্তের কারণে পরিকল্পনা অনিশ্চিত।

প্রাথমিকভাবে অসুবিধা হতে পারে বলে স্বীকার করেছেন মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। তবে তার দাবি, দীর্ঘমেয়াদে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।


বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনেই নতুন বই তুলে দেওয়ার যে ঐতিহ্য তৈরি হয়েছে, তা এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। আইন পরিবর্তন হলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর বই ছাপার দায়িত্ব নেবে, কিন্তু সমন্বয়হীনতা কাটানো না গেলে শিক্ষার্থীরা আবারও ভোগান্তিতে পড়বে।

এনসিটিবিকে পাশ কাটিয়ে নতুন ব্যবস্থার প্রয়োগ সত্যিই শিক্ষায় উন্নতি বয়ে আনবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের ওপর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *