অনলাইন আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
সূত্র: আল জাজিরা
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তাল রাজনীতিতে আবারও আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছেন ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের শীর্ষ নেতা খলিল আল-হায়া। কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত বৈঠকের সময় ইসরায়েলি বিমান হামলার অন্যতম নিশানা ছিলেন তিনি। যদিও এই হামলায় প্রাণে বেঁচে গেছেন, কিন্তু তাঁর ছেলে ও ঘনিষ্ঠ কয়েকজন সহযোগী নিহত হয়েছেন।
কাতার এ হামলাকে আখ্যা দিয়েছে “কাপুরুষোচিত” এবং “আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন” হিসেবে। অন্যদিকে ইসরায়েল স্বীকার করেছে যে হামাস নেতাদের লক্ষ্য করেই এ বিমান হামলা চালানো হয়েছিল। হামাসও জানিয়েছে, তাঁদের পাঁচ সদস্য এবং একজন কাতারি কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।
খলিল আল–হায়া: হামাসের আলোচক ও কৌশলী নেতা
১৯৬০ সালে গাজায় জন্ম নেওয়া খলিল আল-হায়া হামাসের প্রতিষ্ঠালগ্ন (১৯৮৭ সাল) থেকেই সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি সংগঠনের ভেতরে এক প্রভাবশালী কূটনৈতিক মুখ হিসেবে পরিচিতি পান।
গত কয়েক বছরে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ইসমাইল হানিয়ার মৃত্যুর পর ইয়াহিয়া সিনওয়ার নেতৃত্বে আসেন, কিন্তু ২০২৪ সালে তাঁকেও হত্যা করা হয়। এ অবস্থায় হামাস গঠন করে অস্থায়ী পাঁচ সদস্যের নেতৃত্ব পরিষদ, যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য আল–হায়া।
তাঁকে বিশেষভাবে মূল্যবান করে তুলেছে তাঁর কূটনৈতিক অবস্থান। কাতারে নির্বাসনে থাকায় তিনি ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, মিসরসহ একাধিক দেশের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও সমন্বয় করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষ করে গাজার অবরুদ্ধ অবস্থার কারণে ভেতর থেকে যা সম্ভব ছিল না, তা তিনি কাতার থেকে সফলভাবে করে আসছিলেন।
পরিবারের ওপর হামলা ও ব্যক্তিগত ক্ষতি
খলিল আল–হায়ার পরিবারও ইসরায়েলি আগ্রাসনের শিকার। ২০১৪ সালের গাজা যুদ্ধে ইসরায়েলি বিমান হামলায় তাঁর বড় ছেলে ওসামা, ওসামার স্ত্রী এবং তাঁদের তিন সন্তান নিহত হন। সর্বশেষ দোহায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন তাঁর আরেক ছেলে হুমাম আল–হায়া।
আল–হায়া আল–জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“যেকোনো প্রাণহানিই মর্মান্তিক। আন্দোলনের নেতৃত্বের রক্তও ঠিক ততটাই মূল্যবান, যতটা কোনো ফিলিস্তিনি শিশুর রক্ত।”
ইসরায়েলি হামলায় আর কারা নিশানায় ছিলেন?
খলিল আল–হায়ার পাশাপাশি নিশানায় ছিলেন হামাসের আরেক প্রভাবশালী নেতা জাহের জাবারিন। তিনি সংগঠনের আর্থিক দপ্তরের প্রধান ও নেতৃত্ব পরিষদের সদস্য।
জাবারিন ১৯৯৩ সালে ইসরায়েলের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে প্রায় দুই দশক কারাভোগ করেন। পরে ২০১১ সালে বন্দি বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে মুক্তি পান। মুক্তির পর দ্রুত শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে এসে তিনি হামাসের বিনিয়োগ ও অর্থায়ন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করতে থাকেন। বর্তমানে পশ্চিম তীরে হামাসের প্রধান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।
কাতার হামলায় নিহতরা
হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন—
- জিহাদ লাবাদ (আল–হায়ার দপ্তরের পরিচালক)
- হুমাম আল–হায়া (খলিল আল–হায়ার ছেলে)
- আবদুল্লাহ আবদুল ওয়াহিদ (দেহরক্ষী)
- মোয়ামেন হাসসুনা
- আহমেদ আল–মামলুক
- বদর সাদ মোহাম্মদ আল–হুমাইদি আল–দোসারি (কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা)
হামাসের বর্তমান নেতৃত্ব কাঠামো
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় যুদ্ধ শুরুর পর ইসরায়েল হামাসের একাধিক শীর্ষ নেতাকে হত্যা করেছে। এর পর সংগঠনটি পাঁচ সদস্যের অস্থায়ী নেতৃত্ব পরিষদ গঠন করে। বর্তমানে নেতৃত্বে আছেন—
- খলিল আল–হায়া : নির্বাসনে থাকা আলোচক ও রাজনৈতিক নেতা।
- জাহের জাবারিন : আর্থিক কার্যক্রমের প্রধান।
- ইজ্জ আল–দীন আল–হাদ্দাদ : গাজার সর্বোচ্চ সামরিক নেতা, ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় আছেন।
- খালেদ মেশাল : নব্বইয়ের দশক থেকে পরিচিত জ্যেষ্ঠ রাজনৈতিক নেতা। বর্তমানে কাতারে অবস্থান করছেন।
- মোহাম্মদ দারবিশ : নেতৃত্ব পরিষদের প্রধান। তুরস্কে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠক করে যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার জন্য জাতীয় ঐক্যের সরকারের প্রস্তাব সমর্থন করেন।
- নিজার আওয়াদাল্লাহ : দীর্ঘদিনের প্রভাবশালী নেতা, বর্তমানে গণমাধ্যমে অনুপস্থিত।
হামলার রাজনৈতিক তাৎপর্য
ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য স্পষ্ট—হামাসের আলোচক দল ও নেতৃত্বকে দুর্বল করা। বিশেষত যুদ্ধবিরতির আলোচনায় যাঁরা সক্রিয়, তাঁদের টার্গেট করা হচ্ছে। তবে খলিল আল–হায়ার মতো নেতাদের হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ হওয়া প্রমাণ করছে যে হামাস এখনও সমন্বিতভাবে টিকে আছে।
মধ্যপ্রাচ্যের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আল–হায়া ভবিষ্যতে হামাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় মুখ হয়ে উঠতে পারেন। কারণ তিনি একইসঙ্গে কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক দুই ক্ষেত্রেই সক্রিয়, যা তাঁকে অন্যদের থেকে আলাদা করে।
