সুনামগঞ্জ হাওরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে সমালোচনা

সুনামগঞ্জের দেখার হাওরে প্রস্তাবিত জমি—বছরের অধিকাংশ সময় পানির নিচে থাকে, সেখানেই স্থাপন করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়। হাওরের জমিতে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ—পরিবেশ ও কৃষি ধ্বংসের শঙ্কা। ছবি সংগ্রহীত

অনলাইন ডেস্ক:

হাওরের বুকে বিশ্ববিদ্যালয়!

চারদিকে থইথই পানি, মাঝেমধ্যে কেবল বিদ্যুতের খুঁটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শুষ্ক মৌসুমে যেখানে সোনালি ধানের বোনা হয়, বর্ষায় সেখানে থাকে অবারিত পানি। এমন জমিতেই প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ চলছে সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

প্রকল্পটি বর্তমানে রয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। নির্ধারিত স্থানটি সুনামগঞ্জ সদর ও শান্তিগঞ্জ উপজেলার সীমানায়, দেখার হাওর এলাকায়। সুনামগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে এই জমি বছরে সাত মাস পানির নিচে থাকে।


প্রস্তাবিত ভূমি ও পরিবেশগত বাস্তবতা

পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জমি ১২৫ একর।

  • এর মধ্যে ১০০ একরে ধানের আবাদ হয়।
  • প্রায় ১৫ একর পতিত জমি
  • ৫ একর কবরস্থান
  • ১ একর বীজতলা জমি
    এ ছাড়া কিছু জমি বিল ও বাড়ি শ্রেণিভুক্ত।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুষ্ক মৌসুমে এই জমি ধান উৎপাদনের ভান্ডার। বর্ষায় তা মাছের আধার। একইসাথে এটি গোচারণ ভূমি ও পাখিসহ বিভিন্ন জীববৈচিত্র্যের আশ্রয়স্থল। এ ধরণের প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কৃষি, মৎস্য ও জীববৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি হবে।


রাজনৈতিক টানাপোড়েন

বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান নির্বাচন শুরু থেকেই রাজনীতিকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেছে। অনেকে চাইছিলেন প্রতিষ্ঠানটি জেলা সদরে হোক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্থান নির্ধারণ হয় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের বাড়ির কাছাকাছি হাওর এলাকায়।

সমালোচকরা বলছেন, এটি রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে হয়েছে। জেলা সদরে স্থাপন করলে পরিবেশ ও অবকাঠামোগত দিক থেকে সুবিধাজনক হতো। আন্দোলনকারীরা ইতোমধ্যে তিনটি বিকল্প জায়গার প্রস্তাব দিয়েছেন—

  • লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের জুগিরগাঁও
  • গৌরারং ইউনিয়নের রতনশ্রী এলাকা
  • সুনামগঞ্জ পৌরসভার হাসননগর সংলগ্ন এলাকা।

আইন ও অনুমোদনের ইতিহাস

২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর আইন পাস করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমোদন দেয় আওয়ামী লীগ সরকার।
২০২৩ সালের আগস্টে ইউজিসি শিক্ষাকার্যক্রম চালুর অনুমতি দেয়। বর্তমানে শান্তিগঞ্জ উপজেলায় ভাড়া ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যক্রম চলছে। চারটি বিভাগে পড়ছেন প্রায় ১৬০ জন শিক্ষার্থী।

কিন্তু স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি অধিগ্রহণে প্রশাসনিক জটিলতা ও বিতর্ক অব্যাহত আছে। পরিকল্পনা কমিশন প্রকল্পে অসংগতি পেয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, যদিও সংশোধন করে আবার জমা দেওয়া হয়েছে। ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৯৯ কোটি টাকা


স্থানীয় মানুষের ক্ষোভ

মোনাজ্জির হোসেন, সুনামগঞ্জে জেলা সদরে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তবায়ন আন্দোলনের সদস্যসচিব, বলেন—
“দেখার হাওর ধান ও মাছের ভান্ডার। একে ধ্বংস করে বিশ্ববিদ্যালয় করলে কৃষি ও পরিবেশ দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা চাই এটি জেলা সদরের উঁচু জমিতে হোক।”

সাধারণ মানুষও একই সুরে বলছেন, হাওর ধ্বংস না করে বিকল্প জমি বেছে নেওয়া হোক।


সরেজমিনে যা দেখা গেল

গত ২৪ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্ধারিত জায়গায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো জমি পানির নিচে। কোনো রাস্তা নেই, আশপাশে জনবসতিও নেই। স্থানীয় এক তরুণ নৌকায় করে সাংবাদিকদের নিয়ে জায়গাটি ঘুরিয়ে দেখান। তিনি বলেন, “সাত মাস এখানে পানি থাকে, কিছু জায়গায় পানির গভীরতা পাঁচ ফুট।”


বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বক্তব্য

উপাচার্য অধ্যাপক মো. নিজামুল হক দাবি করেছেন, জমিটি হাওরের ভেতরে নয়, বরং হাওরের পাড়ে। তবে তিনি স্বীকার করেন, বিষয়টি মূলত সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে।

অন্যদিকে সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টি তিনি নিজ বাড়ির কাছে স্থাপনের জন্য চাপ দেননি। বরং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নতুন জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “ভালো জায়গা পাওয়া গেলে সেখানে করা হোক।”


পরিবেশবাদীদের সতর্কবার্তা

পরিবেশবিদরা বলছেন, হাওরের বাইরে হলেও জমি ভরাট করলে প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ ব্যাহত হবে। এর ফলে মাছ ও ধান উৎপাদন হুমকির মুখে পড়বে। এছাড়া একে কেন্দ্র করে নতুন জনবসতি গড়ে উঠলে হাওর অঞ্চলের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

সজল কান্তি সরকার, সংগঠন ‘ধরা’র সমন্বয়ক, বলেন—
“এখানে বিশ্ববিদ্যালয় হলে নাইন্দা নদীর প্রবাহ ব্যাহত হবে। পাশাপাশি জমি ভরাটের হিড়িক শুরু হবে, যা ভবিষ্যতে হাওরের কৃষি ও মৎস্য সম্পদ ধ্বংস করবে।”


বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে বিতর্ক

বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বর্তমানে ৬১। এর মধ্যে ১৮টির নিজস্ব ক্যাম্পাস নেই। অনেকগুলোই ভাড়া ভবনে চলছে। চলনবিলে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়েও একই ধরনের বিতর্ক রয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শিক্ষা বিস্তারের নামে অযথা বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ানো হচ্ছে, অথচ মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। আর স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য সঠিক জায়গা নির্বাচন না হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার ঝুঁকি বাড়ছে।


সুনামগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে শিক্ষার প্রসারের জন্য একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। তবে জায়গা নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক এবং হাওর ধ্বংসের শঙ্কা এ প্রকল্পকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এখন মূল চ্যালেঞ্জ হলো—শিক্ষা ও পরিবেশের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে টেকসই সিদ্ধান্ত নেওয়া।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *