ঢাকার বায়ুদূষণ আবারও অস্বাস্থ্যকর পর্যায়ে, বিশ্ব তালিকার শীর্ষে দিল্লি

ঢাকার বায়ুদূষণে আকাশে ধোঁয়া ও ধুলায় ঢেকে থাকা নগরদৃশ্য। ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়ে AQI ১৭৯-এ পৌঁছেছে, শীর্ষে রয়েছে দিল্লি। ছবি সংগ্রহীত

অনলাইন ডেস্ক:

বিশ্বের বিভিন্ন বড় শহরগুলোতে দিন দিন বাড়ছে বায়ুদূষণ। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশের শিল্পনগরীগুলোতে দূষণের মাত্রা ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। এরই ধারাবাহিকতায় দীর্ঘদিন ধরে বায়ুদূষণের কবলে থাকা দক্ষিণ এশিয়ার মেগাসিটি ঢাকা আবারও ‘অস্বাস্থ্যকর’ বায়ুমানের তালিকায় উঠে এসেছে। গত কয়েক সপ্তাহে বায়ুদূষণের মাত্রা কিছুটা কমলেও গত দুদিন ধরে রাজধানীর বাতাস আবারও বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।

আন্তর্জাতিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইকিউএয়ার (IQAir)–এর মতে, শনিবার (১৫ নভেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টার পর ঢাকার এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) স্কোর দাঁড়ায় ১৭৯, যা ‘অস্বাস্থ্যকর’ হিসেবে বিবেচিত। এ স্কোর নিয়ে ঢাকা বিশ্বে দূষিত শহরের তালিকায় চতুর্থ স্থানে রয়েছে।

দিল্লি আবারও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর

একই সময়ে ভারতের রাজধানী দিল্লির AQI স্কোর ছিল ৫১১, যা মারাত্মক মাত্রার দূষণ। আন্তর্জাতিক স্কেলে ৫০০–এর উপরে AQI পড়া “Hazardous” বা ‘জীবনহানিকর’ অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। কয়েক বছর ধরেই দিল্লি শীত মৌসুমে এমন ভয়াবহ দূষণের শিকার হচ্ছে। শস্য পোড়ানো, যানবাহনের ধোঁয়া, শিল্পকারখানার নির্গমন, আবহাওয়ার স্থিরতা—সবকিছু মিলে দিল্লি বায়ুদূষণের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়।

বিশ্বের শীর্ষ দূষিত শহরগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়া আধিপত্যে

আইকিউএয়ারের র‍্যাংকিং অনুযায়ী, ১৫ নভেম্বরের সকাল পর্যন্ত শীর্ষ পাঁচ দূষিত শহর হলো—

  1. দিল্লি (ভারত) — AQI ৫১১
  2. লাহোর (পাকিস্তান) — AQI ২৭৪
  3. কলকাতা (ভারত) — AQI ১৯৯
  4. ঢাকা (বাংলাদেশ) — AQI ১৭৯
  5. বাগদাদ (ইরাক) — AQI ১৭৫

এই তালিকা দেখে স্পষ্ট যে দক্ষিণ এশিয়ার শহরগুলোর মধ্যেই বায়ুদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।

AQI স্কোর কী বোঝায়? সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবেন?

বায়ুমানের পরিমাপের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে AQI (Air Quality Index) ব্যবহার করা হয়।
স্কোর অনুযায়ী তার ব্যাখ্যা হলো—

AQI স্কোরবায়ুমানের অবস্থামন্তব্য
০–৫০ভালোকোনো ঝুঁকি নেই
৫১–১০০মাঝারিসংবেদনশীলদের জন্য সামান্য ঝুঁকি
১০১–১৫০সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকরশিশু–বয়স্কদের সতর্কতা
১৫১–২০০অস্বাস্থ্যকরসবারই স্বাস্থ্যঝুঁকি থাকে
২০১–৩০০খুব অস্বাস্থ্যকরবাইরে কম বেরোনোর পরামর্শ
৩০১–৪০০ঝুঁকিপূর্ণবড় ধরনের স্বাস্থ্যহানি হতে পারে
৪০১–৫০০+মারাত্মক/জীবনঘাতীজরুরি অবস্থা

ঢাকার বর্তমান AQI ১৭৯, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের শ্বাসযন্ত্রে জ্বালা, কাশি, হাঁচি, অ্যাজমা এবং মাথাব্যথার ঝুঁকি বাড়ে।

ঢাকার বায়ুদূষণ: কেন বাড়ছে?

বিশেষজ্ঞদের মতে ঢাকার বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলো হলো—

  • ইটভাটা
  • যানবাহনের ধোঁয়া
  • মেট্রোরেল ও মেগা প্রজেক্ট নির্মাণ
  • খোলা জায়গায় আবর্জনা পোড়ানো
  • শিল্পকারখানার নিঃসরণ
  • ধুলাবালি

শহরে সবুজায়নের অভাব ও জনসংখ্যার ঘনত্বও পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে।

দুই দিন ধরে ঢাকার বাতাস খারাপ: কী ঘটল?

গত কয়েকদিনে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হালকা শীতের অনুভূতি দেখা দিয়েছে। এ সময়ে বাতাসে আর্দ্রতা বেশি থাকায় ধুলোকণা উপরে উঠতে পারে না। ফলে কম উচ্চতায় স্থির হয়ে থাকে। এতে Particulate Matter (PM2.5) দ্রুত বেড়ে যায়।

বায়ুদূষণের বড় অংশই এই PM2.5, যা মানুষের ফুসফুসে ঢুকে রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে।

স্বাস্থ্যঝুঁকি: কারা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—
ঢাকার মত শহরে এই AQI মানুষের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে—

  • শিশু
  • গর্ভবতী নারী
  • বয়স্ক মানুষ
  • ফুসফুস বা হৃদরোগী
  • অ্যাজমা রোগীরা

তাদের ঘরের বাইরে কম বেরোনোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

দূষিত বাতাস সরাসরি কারণ হতে পারে—

  • অ্যালার্জি
  • ব্রংকাইটিস
  • শ্বাসকষ্ট
  • শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহ
  • হৃদরোগ
  • এমনকি ক্যানসার পর্যন্ত

ঢাকা শহরে প্রতি বছর দূষণের কারণে হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে—এমন তথ্যও রয়েছে বিভিন্ন গবেষণায়।

বিশেষজ্ঞদের করণীয় পরামর্শ

স্বাস্থ্যবিদদের মতে ঢাকার মতো শহরে নিরাপদ থাকতে—

  • বাইরে গেলে মাস্ক ব্যবহার
  • দীর্ঘসময় খোলা জায়গায় না থাকা
  • সকালে শিশুদের বাইরে কম নিয়ে যাওয়া
  • ঘরে HEPA ফিল্টারযুক্ত এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার
  • বেশি পানি পান
  • চুলা বা আবর্জনা পোড়ানো বন্ধ রাখা
  • যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ

এগুলো জরুরি।

দূষণ কমাতে কী করতে পারে সরকার?

বিশেষজ্ঞরা বলছেন—

✔ নির্মাণ কাজের ধুলা নিয়ন্ত্রণ
✔ ইটভাটা আধুনিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর
✔ ডিজিটাল যানবাহন পরিদর্শন ব্যবস্থা চালু
✔ নগরে সবুজ এলাকা বৃদ্ধি
✔ প্রয়োজনহীন হর্ন–দূষণ কমানো

সরকার ইতোমধ্যেই অনেক উদ্যোগ নিয়েছে, তবে বাস্তবায়নে গতি আনতে হবে।

ঢাকার বায়ুদূষণ আবারও ‘অস্বাস্থ্যকর’ হওয়ার বার্তা কী দেয়?

ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা প্রমাণ করে—

  • নগর পরিকল্পনায় বড় দুর্বলতা আছে
  • প্রকৃতির সাথে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে
  • সমন্বিত ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন
  • পরিবেশ সুরক্ষায় বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগ বাড়াতে হবে

দক্ষিণ এশিয়ার বড় শহরগুলোতে দূষণের তীব্রতা উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। জলবায়ুবান্ধব নগর গঠনের উদ্যোগই একমাত্র টেকসই পথ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *