জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে: প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে নতুন দিকনির্দেশনা

জাতির উদ্দেশে ভাষণে জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।” প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জুলাই সনদ, উচ্চকক্ষ, গণভোট ও রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের দিকনির্দেশনা। ছবি : বিটিভি

অনলাইন ডেস্ক:

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে আজ বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটায় দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভাষণে জুলাই জাতীয় সনদ, জাতীয় নির্বাচন, গণভোট, উচ্চকক্ষ গঠনসহ সাংবিধানিক সংস্কারের বিস্তৃত দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন। তাঁর এই ভাষণ দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, গণমাধ্যম এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ভাষণটির মূল বার্তা—আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে, এবং চারটি বিষয়ে একটিমাত্র প্রশ্নে জনগণ মতামত জানাতে পারবে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ ভোট বিজয়ী হলে সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট, যেখানে দলীয় প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের একটি উচ্চকক্ষ তৈরি হবে। সংবিধান সংশোধনেও থাকবে এই উচ্চকক্ষের অনুমোদন।

প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের শুরুতেই উঠে আসে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ। তিনি বলেন, “গত বছর আগস্ট মাসে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শক্তিবলে তাঁরা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেছিলেন। এখন সরকারের মেয়াদে তাঁরা একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে পৌঁছেছেন।” সরকারের তিনটি প্রধান দায়িত্ব—হত্যাকাণ্ডের বিচার, গণতান্ত্রিক সংস্কার, এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর—ভাষণে বিশেষভাবে উল্লেখ করেন তিনি।

হত্যাকাণ্ড ও নিখোঁজদের বিচার অগ্রগতির কথা

ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস জানান, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিচার দ্রুতগতিতে এগোচ্ছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শিগগির প্রথম রায় ঘোষণা করতে যাচ্ছে। একইসঙ্গে কয়েকটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সাধারণ আদালতেও চলছে জুলাই হত্যাকাণ্ড সংশ্লিষ্ট মামলার বিচার। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ‘গুম’–এর মতো নৃশংস অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে—এ তথ্যটিও ভাষণে উল্লেখ করেন তিনি।

সংস্কারের চিত্র তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা

তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বিচার বিভাগ, আর্থিক খাত, স্বচ্ছতা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও ডিজিটালাইজেশনসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার ইতোমধ্যে সম্পন্ন করেছে। কিছু সংস্কার চলছে। ভবিষ্যতের জনবান্ধব সুশাসনের জন্য এসব কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। আশা প্রকাশ করেন যে, নির্বাচিত সরকার সংসদে আলোচনার মাধ্যমে এসব সংস্কার গ্রহণ করবে।

সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি

প্রধান উপদেষ্টা জানান, আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, “নির্বাচনকে উৎসবমুখর, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।”

ঐকমত্য কমিশনের কাজ ও অর্জন

রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারের লক্ষ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যে ৯ মাসব্যাপী কাজ করেছে, তা ভাষণে উল্লেখ করেন তিনি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দীর্ঘ সংলাপ, সরাসরি সম্প্রচার, এবং ৩০টি সংস্কার প্রস্তাবে ঐকমত্য—সবই বাংলাদেশের রাজনীতিতে নজিরবিহীন অর্জন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তিনি বলেন, “কিছু প্রস্তাবে সামান্য ভিন্নমত আছে, তবে তা গভীর নয়। সংস্কারের নীতি ও লক্ষ্য নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদ নেই।”

জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে

ভাষণে সবচেয়ে আলোচিত অংশ ছিল জাতীয় নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজনের ঘোষণা।

তিনি বলেন,
“আমরা সব বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনেই গণভোটের আয়োজন করা হবে। এতে নির্বাচন আরও উৎসবমুখর ও সাশ্রয়ী হবে।”

একইসঙ্গে তিনি জানান, গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় আইন উপযুক্ত সময়ে প্রণয়ন করা হবে।

চার বিষয়ে এক প্রশ্নে গণভোট

ভাষণে তিনি গণভোটের প্রশ্নও পড়ে শোনান:

ক. নির্বাচনকালীন সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং অন্যান্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান জুলাই সনদে বর্ণিত প্রক্রিয়ার আলোকে গঠন করা হবে।
খ. আগামী সংসদ হবে দুই কক্ষবিশিষ্ট। দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে ১০০ সদস্যের উচ্চকক্ষ গঠিত হবে এবং সংবিধান সংশোধনে এই উচ্চকক্ষের অনুমোদন বাধ্যতামূলক হবে।
গ. সংসদে নারীর প্রতিনিধিত্ব বৃদ্ধি, বিরোধী দল থেকে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ সীমিতকরণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণসহ জুলাই সনদে ঐকমত্য হওয়া ৩০টি প্রস্তাব বাস্তবায়নে আগামী নির্বাচনে বিজয়ী দল বাধ্য থাকবে।
ঘ. জুলাই সনদে বর্ণিত অন্যান্য সংস্কার রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি অনুসারে বাস্তবায়ন করা হবে।


উচ্চকক্ষ গঠনের সময়সীমা ও প্রক্রিয়া

গণভোটে ‘হ্যাঁ’ প্রাপ্ত হলে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সংবিধান সংস্কার পরিষদ গঠন হবে—এ তথ্য ভাষণে তুলে ধরেন তিনি। পরিষদ ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে কাজ শেষ করবে। এরপর ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে দলীয় ভোটের অনুপাতে উচ্চকক্ষ গঠন করা হবে, যার মেয়াদ থাকবে নিম্নকক্ষের শেষ দিন পর্যন্ত।

জুলাই জাতীয় সনদকেও সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা দেন তিনি।

অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে বক্তব্য

লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গেমচেঞ্জার হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি। জানান, এপিএম টার্মিনালের সঙ্গে ৫৫০ মিলিয়ন ডলারের কনসেশন চুক্তি স্বাক্ষর হতে যাচ্ছে—যা বাংলাদেশের ইতিহাসে ইউরোপের সর্বোচ্চ একক বিনিয়োগ।

তাঁর দাবি, রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ, রিজার্ভসহ অর্থনীতির সব সূচকেই ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। ব্যাংকিং খাতও ঘুরে দাঁড়িয়েছে।

সুষ্ঠু নির্বাচন ও ঐক্যের আহ্বান

ভাষণের শেষ অংশে তিনি নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন—

“ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ২০২৪-এর জুলাইয়ে দেশবাসী যে ঐক্য গড়ে তুলেছিল, আমরা যেন সামান্য ভিন্নমতে তার মর্যাদা ক্ষুণ্ন না করি। জনগণ চায় আমরা সম্মিলিতভাবে জাতীয় স্বার্থকে এগিয়ে নেই।”

তিনি আশা প্রকাশ করেন, রাজনৈতিক দলগুলো এই সিদ্ধান্তকে জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গ্রহণ করবে এবং বাংলাদেশ নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *