নির্বাচনের আগে সাইবার ঝুঁকিতে দেশের ৩৬% ব্যাংক, ব্যয় বাড়লেও সুরক্ষায় ঘাটতি

বাংলাদেশের ৩৬ শতাংশ ব্যাংক সাইবার হামলার ঝুঁকিতে নির্বাচনের আগে সাইবার হামলার ঝুঁকিতে দেশের ব্যাংক খাত, প্রতীকি ছবি

অনলাইন ডেস্ক:

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বর্তমানে এক বড় ধরনের সাইবার ঝুঁকির মুখে রয়েছে। প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করার চেষ্টা করা হলেও, এখনও দেশের প্রায় ৩৬ শতাংশ ব্যাংক সর্বোচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় নির্বাচনের আগে এই ঝুঁকি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সরকার।

ক্রমবর্ধমান ব্যয়, তবু ঝুঁকি কমছে না

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাইবার নিরাপত্তায় মোট ব্যয় হয়েছে ৫৩ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। অথচ এই বিপুল ব্যয়ের পরও ব্যাংক খাত সাইবার হামলার কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)-এর তথ্য বলছে, ২০২৪ সালের মার্চ শেষে দেশে প্রায় ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট এবং প্রায় ১ কোটি ৪৩ লাখ অগ্রিম হিসাব রয়েছে। এর পাশাপাশি ব্যাংকের শাখা, এটিএম, সিআরএম, এজেন্ট ব্যাংকিং ও ইন্টারনেট ব্যাংকিং সেবার বিস্তারও বেড়েছে বহুগুণে। কিন্তু এই সম্প্রসারণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সাইবার সুরক্ষা বাড়েনি। ফলে ব্যাংকগুলো হ্যাকারদের সহজ টার্গেটে পরিণত হচ্ছে।

প্রতিদিন শত শত হামলা

বিআইবিএমের তথ্যে দেখা যায়, প্রতিদিন দেশের ব্যাংক খাতে ১৪৫ থেকে ৬৩০ বার পর্যন্ত সাইবার হামলা হয়। এর বড় একটি অংশ চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত হলেও, দেশের ভেতর থেকেও প্রায় ২ শতাংশ হামলা হয়ে থাকে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা

ব্র্যাক ব্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ফারুক মাঈনুদ্দিন বলেন, “ব্যাংকগুলো নিরাপত্তার জন্য সফটওয়্যার ও টুলস কিনলেও রক্ষণাবেক্ষণে বিনিয়োগ করতে চায় না। বোর্ডের অনুমোদনের জটিলতা থাকায় অনেক সময় দেরি হয়, আর এই ফাঁকেই হ্যাকাররা সুযোগ নেয়।”

বিআইবিএমের অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান আলম বলেন, “সাইবার হামলার ধরন প্রতিনিয়ত পাল্টাচ্ছে। নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে আপডেট না থাকলে ঝুঁকি বাড়ে। বড় ব্যাংকগুলো তুলনামূলক বেশি বিনিয়োগ করছে, তবে ছোট ব্যাংকগুলো পিছিয়ে রয়েছে।”

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবিরও মনে করেন, বড় ধরনের সাইবার হামলার পেছনে প্রায়ই ইনসাইডারদের যোগসাজশ থাকে।

হামলার ধরন

তথ্য বলছে,

  • ৬৮% হামলা ম্যালওয়্যার
  • ৪৮% ডস ও ফিশিং
  • ৪৬% স্প্যাম
  • ২৭% ভেন্ডরের মাধ্যমে
  • এবং প্রায় ১৬% হামলা অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা বা হ্যাকটিভিস্টদের সহযোগিতায় হয়।

ক্ষতির চিত্র

একবার ব্যাংক কোনো সাইবার হামলার শিকার হলে—

  • ৩৭% ব্যয় হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারে পুনর্বিনিয়োগে চলে যায়
  • ১৮% গ্রাহকের ব্যবসায়িক ক্ষতি হয়
  • এবং ৩৫% সরাসরি আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয়

বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কতা

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফুল হোসেন বলেন, “ব্যাংকগুলো যাতে অবহেলা না করে, সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কোনো ব্যাংক অপ্রস্তুত থাকলে বা কর্মকর্তাদের যোগসাজশ প্রমাণিত হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।”


বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত যেমন দ্রুত ডিজিটাল হচ্ছে, তেমনি বাড়ছে সাইবার ঝুঁকি। প্রযুক্তির যুগে অর্থনীতি টিকিয়ে রাখতে সাইবার নিরাপত্তায় বিনিয়োগ শুধু সফটওয়্যার কেনায় সীমাবদ্ধ না থেকে নিয়মিত আপডেট ও রক্ষণাবেক্ষণের দিকেও জোর দেয়া জরুরি। অন্যথায়, নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটি বড় ধরনের সাইবার হামলা দেশের আর্থিক খাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *