নভেম্বরে চালু হচ্ছে বিকাশ-নগদ-রকেট আন্তঃলেনদেন: হাজারে খরচ সর্বোচ্চ ৮ টাকা ৫০ পয়সা

বাংলাদেশে ডিজিটাল লেনদেনের প্রতীকী দৃশ্য—একজন ব্যবহারকারী মোবাইল ফোনে বিকাশ, নগদ, রকেট ইত্যাদি এমএফএসের মাধ্যমে টাকা পাঠাচ্ছেন। এখন থেকে বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায়ের গ্রাহকেরা একে অপরকে সরাসরি টাকা পাঠাতে পারবেন—মোবাইল থেকেই মুহূর্তে। প্রতীকি ছবি

অনলাইন ডেস্ক:

ডিজিটাল লেনদেনে নতুন যুগের সূচনা

বাংলাদেশের ডিজিটাল লেনদেনব্যবস্থায় বড় এক পরিবর্তন আসছে। নভেম্বর মাস থেকেই মোবাইল আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সরাসরি টাকা পাঠানো যাবে—অর্থাৎ বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, এম-ক্যাশ বা ট্যাপের যেকোনো হিসাব থেকে অন্য এমএফএসে অর্থ স্থানান্তর করা সম্ভব হবে।

এখন পর্যন্ত গ্রাহকরা কেবল একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে (যেমন বিকাশ থেকে বিকাশে) টাকা পাঠাতে পারতেন। নতুন নিয়ম চালু হলে এক এমএফএস থেকে অন্য এমএফএসে বা ব্যাংকে অর্থ পাঠানো হবে মুহূর্তেই।


নতুন কী আসছে

আগে “বিনিময় অ্যাপ” এর মাধ্যমে এক এমএফএস থেকে অন্য এমএফএসে টাকা পাঠানো সম্ভব ছিল, কিন্তু তা ছিল জটিল ও সীমিত। উভয় পক্ষকেই বিনিময় অ্যাপে নিবন্ধিত থাকতে হতো। নতুন ব্যবস্থায় এসব ঝামেলা থাকবে না।

এখন একজন বিকাশ গ্রাহক সহজেই নগদ বা রকেট ব্যবহারকারীর কাছে টাকা পাঠাতে পারবেন।
আরেকজন রকেট ব্যবহারকারী উপায় বা এম-ক্যাশে অর্থ পাঠাতে পারবেন একইভাবে।

এ উদ্যোগটি আসছে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ন্যাশনাল পেমেন্ট সুইচ অব বাংলাদেশ (NPSB)-এর মাধ্যমে। এই অবকাঠামো ব্যাংক, এমএফএস ও পেমেন্ট সার্ভিস প্রোভাইডার (PSP)-দের একত্রে সংযুক্ত করবে, যেন সব প্ল্যাটফর্মের মধ্যে টাকা লেনদেন করা যায়।


খরচ কত হবে (লেনদেন মাশুল)

বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যে প্রতিটি লেনদেনের সর্বোচ্চ মাশুল নির্ধারণ করে দিয়েছে।

প্রেরক (Sender)গন্তব্য (Receiver)সর্বোচ্চ মাশুল প্রতি ১,০০০ টাকায়মন্তব্য
ব্যাংক থেকে ব্যাংক / এমএফএস / PSP৳ ১.৫০ব্যাংক চাইলে বিনামূল্যে সেবা দিতে পারবে
বিকাশ / নগদ / রকেট / উপায় (MFS → অন্য MFS, ব্যাংক, PSP)৳ ৮.৫০হাজারে সর্বোচ্চ সাড়ে আট টাকা
PSP → ব্যাংক বা এমএফএস৳ ২.০০লেনদেনের মধ্যস্থতাকারীদের মধ্যে রাজস্ব ভাগাভাগি থাকবে

এ অর্থ রেভিনিউ শেয়ারিং মডেলে ভাগ হবে—অর্থাৎ NPSB, প্রেরক ও গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান সবাই একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে।


কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ

বাংলাদেশে এমএফএস অ্যাকাউন্টধারীর সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৪ কোটি ৬৪ লাখ, যাদের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়।
আগে এসব লেনদেন এক-একটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকায় ডিজিটাল পেমেন্টের পরিধি সীমিত ছিল।

নতুন নিয়মে:

  • গ্রাহকরা সহজে অন্য প্রতিষ্ঠানে টাকা পাঠাতে পারবেন
  • ছোট ব্যবসায়ীরা যেকোনো ওয়ালেটেই পেমেন্ট নিতে পারবেন
  • ব্যাংক ও এমএফএসের মধ্যে অর্থ স্থানান্তর হবে মুহূর্তেই
  • অনানুষ্ঠানিক নগদ লেনদেন অনেক কমে যাবে

এতে ডিজিটাল বাংলাদেশ-এর অর্থনীতি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক (inclusive) হয়ে উঠবে।


ব্যাংক ও PSP-এর ভূমিকা

ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যে তাদের মোবাইল অ্যাপ থেকে অন্য ব্যাংকে টাকা পাঠানোর সুযোগ দিয়েছে।
এখন তারা এমএফএস ও PSP অ্যাকাউন্টেও সহজে অর্থ পাঠাতে পারবে।
কিছু ব্যাংক যেমন ক্রেডিট কার্ড বিল পরিশোধ বা ই-কমার্স পেমেন্টে এমএফএসের সুবিধা দিয়েছে, এবার সেটি হবে আরও সহজ ও একীভূত।

PSP (Payment Service Provider) যেমন—SSLCommerz, Q-cash, Foster Payments ইত্যাদি—এখন এমএফএস ও ব্যাংক উভয়ের সঙ্গে তাৎক্ষণিক লেনদেন করতে পারবে।
এর ফলে অনলাইন ব্যবসায় পেমেন্ট প্রক্রিয়া আরও মসৃণ হবে।


বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদ ও খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন—
মাশুল যতটা কম রাখা যায়, তত বেশি মানুষ ডিজিটাল লেনদেনে আগ্রহী হয়।
বহু দেশ সরকারিভাবে ভর্তুকি দিয়ে লেনদেনকে বিনামূল্যে করেছে।
বাংলাদেশেও যদি কিছু সময়ের জন্য ফি কমানো হয় বা প্রণোদনা দেওয়া হয়, তাহলে নগদ টাকার ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমবে।


সম্ভাব্য উদাহরণ

  • আপনি যদি বিকাশ → রকেট ১,০০০ টাকা পাঠান, খরচ সর্বোচ্চ ৳ ৮.৫০
  • যদি ব্যাংক → বিকাশ পাঠান, খরচ মাত্র ৳ ১.৫০
  • PSP → ব্যাংক পাঠালে খরচ ৳ ২.০০

এতে যে কোনো গ্রাহক তার প্রয়োজনমতো যে কোনো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে পারবেন—ঝামেলাহীন, দ্রুত ও নিরাপদভাবে।


সমাজ-অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব

  1. নগদ টাকার ব্যবহার কমবে
    দোকান, বাজার বা ছোট পেমেন্টেও মোবাইল লেনদেন হবে সহজে।
  2. দুর্নীতি ও অর্থপাচার হ্রাস পাবে
    সব লেনদেনের রেকর্ড ডিজিটালভাবে সংরক্ষিত থাকবে।
  3. অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাড়বে
    প্রান্তিক মানুষ ও গ্রামীণ এলাকাও সহজে ডিজিটাল সেবা পাবে।
  4. সরকারি রাজস্ব আয় বাড়বে
    স্বচ্ছ লেনদেনের ফলে কর আদায় সহজ হবে।

চ্যালেঞ্জ ও সতর্কতা

  • প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি: সব প্রতিষ্ঠান একযোগে প্রস্তুত না থাকলে শুরুতে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে।
  • সচেতনতা: অনেক গ্রাহক নতুন সেবা ব্যবহারে অনভ্যস্ত হতে পারেন।
  • নিরাপত্তা: সাইবার নিরাপত্তা ও প্রতারণা প্রতিরোধে নজর বাড়াতে হবে।

সারসংক্ষেপ

বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগের ফলে দেশের ডিজিটাল লেনদেনব্যবস্থায় এক বড় বিপ্লব ঘটতে যাচ্ছে
নভেম্বর থেকে বিকাশ-নগদ-রকেট-উপায়সহ সব এমএফএস, ব্যাংক ও PSP-এর মধ্যে অর্থ স্থানান্তর হবে এক প্ল্যাটফর্মে।

ফলে,

  • হাজারে সর্বোচ্চ ৮ টাকা ৫০ পয়সা খরচে যেকোনো অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো যাবে,
  • গ্রাহক ও ব্যবসায়ীরা পাবেন দ্রুত, সহজ ও নিরাপদ ডিজিটাল পেমেন্ট সুবিধা।

বাংলাদেশের স্মার্ট অর্থনীতির পথে এটি এক বড় পদক্ষেপ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *