অর্থনীতিতে নতুন জোয়ার আনবে পায়রা সমুদ্রবন্দর

দক্ষিণাঞ্চলে উন্নয়ন, শিল্প সম্প্রসারণ ও আমদানি-রফতানির নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসছে পায়রা বন্দর। ছবি সংগ্রহিত

বাংলাদেশের বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে পায়রা সমুদ্রবন্দর। দেশের তৃতীয় সমুদ্রবন্দর হলেও আয়তন ও পরিকল্পনার দিক থেকে এটি এখন পর্যন্ত বৃহত্তম। দক্ষিণাঞ্চলকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই বন্দরকে সরকার চট্টগ্রামের বিকল্প হিসেবে সক্ষম করে তুলতে চায়। এরই মধ্যে বন্দরের প্রথম টার্মিনালের জেটি ও ব্যাকআপ ইয়ার্ড নির্মাণ শেষ হয়েছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজও প্রায় শেষ পর্যায়ে।

পায়রার অবকাঠামোগত উন্নয়ন

পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় নির্মিত এই বন্দরের প্রথম টার্মিনালে রয়েছে ৬৫০ মিটার দীর্ঘ জেটি, যা একসঙ্গে তিনটি বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। পাশাপাশি বিশাল ব্যাকআপ ইয়ার্ডে কনটেইনার ও বাল্ক পণ্য খালাসের আধুনিক সুবিধা যুক্ত হয়েছে। এখন পর্যন্ত অবকাঠামোগত কাজের ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। বাকি রয়েছে আন্ধারমানিক নদীর ওপর ব্রিজ এবং ৬.৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ৬ লেনের সংযোগ সড়ক।

প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন, সম্পূর্ণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই গাড়ি ও বাল্ক পণ্য খালাসের মতো প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব। অর্থাৎ বন্দর আংশিকভাবে চালু হলে দেশের আমদানি-রফতানি ব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দিতে পারে।

অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

প্রথম বছরেই এই বন্দর থেকে নিট আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৬৫০ কোটি টাকা, আর সরকারের রাজস্ব আয় হতে পারে ৬ হাজার কোটি টাকা। দ্বিতীয় বছর আয় আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বন্দরের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তফা আশিক আলী জানিয়েছেন, ২০২৬ সালের জুলাই নাগাদ পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে।

বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রকৌশল ও উন্নয়ন) কমডোর মোহাম্মদ আব্দুল কাদেরের ভাষায়—“প্রথম বছরেই বন্দরের আয় হবে ৬৫০ কোটি টাকা, যেখানে সরকারের রাজস্ব আয় হবে ৬ হাজার কোটি টাকা। পরের বছর এটি আরও বেড়ে যাবে।”

শিল্প সম্প্রসারণ, আমদানি-রফতানি বৃদ্ধি এবং দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়িক কার্যক্রমে প্রাণচাঞ্চল্য আনবে এই বন্দর। বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, “শুধু চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকিপূর্ণ। পায়রা বন্দর সেই ঝুঁকি কমাবে এবং বাল্ক পণ্য পরিবহনে বড় ভূমিকা রাখবে।”

আধুনিক ও পরিবেশবান্ধব বন্দর

পায়রা সমুদ্রবন্দরকে দেশের প্রথম গ্রিন পোর্ট হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ও পরিচালনা ব্যবস্থার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বড় জাহাজ হ্যান্ডলিং, নদীপথে পণ্য পরিবহন এবং শিল্প সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে এই বন্দর।

পায়রা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল মাসুদ ইকবাল বলেন, “দক্ষিণবঙ্গের অর্থনৈতিক উন্নয়নে পায়রা বন্দরের বিশেষ অবদান থাকবে এবং এর বাণিজ্যিক সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি।”

চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা

তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বড় জাহাজের জন্য গভীর নাব্যতা বজায় রাখা। মেঘনা নদীর অববাহিকায় অবস্থিত এই বন্দরে নিয়মিত ড্রেজিংয়ের প্রয়োজন হবে। এর খরচ যথেষ্ট হলেও কর্তৃপক্ষ আশাবাদী যে আয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে এটি লাভজনক রাখা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে, ভাঙা-কুয়াকাটা মহাসড়ক এখনো দুই লেনের হওয়ায় সংযোগ সমস্যার আশঙ্কা রয়েছে। তাই দ্রুত ছয় লেনে উন্নীত না করলে বন্দরের পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো কঠিন হবে।

দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক নতুন দিগন্ত

দেশে অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞ সম্প্রসারণে পায়রা বন্দর বিশাল ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। চট্টগ্রাম বন্দর মূলত কনটেইনার ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভরশীল থাকবে, আর পায়রা বন্দর বাল্ক পণ্য পরিবহনে বিশেষায়িত হবে। এর ফলে দেশের সামগ্রিক আমদানি-রফতানি কার্যক্রম আরও সহজ হবে এবং দক্ষিণাঞ্চলের শিল্পাঞ্চলে নতুন জোয়ার আনবে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বন্দর শুধু আঞ্চলিক অর্থনীতিতেই নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। উন্নত অবকাঠামো, আধুনিক প্রযুক্তি, পরিবেশবান্ধব পরিকল্পনা এবং সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ মিলে এটি হবে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি গেমচেঞ্জার প্রকল্প।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *