চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট: আমদানি বেড়ে চাপ সামলাতে হিমশিম, এনবিআরের কঠোর নির্দেশনা

“চট্টগ্রাম বন্দরে জমে থাকা কনটেইনার, যেখানে ইয়ার্ডে হাজার হাজার কনটেইনার রাখা আছে এবং কর্তৃপক্ষ জট নিরসনে পদক্ষেপ নিচ্ছে।” “চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট কমাতে এনবিআরের নতুন নির্দেশনা, দ্রুত অফডকে কনটেইনার সরানোর নির্দেশ।”, ছবি : সংগৃহিত

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র। দেশের ৯২ শতাংশ আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম এই বন্দরের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। প্রতিদিন শত শত জাহাজ ভিড়ে এবং হাজার হাজার কনটেইনার আনলোড হয়। সম্প্রতি আমদানি বৃদ্ধির সঙ্গে বন্দরে কনটেইনার জট তৈরি হয়েছে, যা শুধু আমদানি-রপ্তানিকারকদের নয় বরং সামগ্রিক অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে। কনটেইনার জট নিরসনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে।


বর্তমান পরিস্থিতি

চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে বর্তমানে ৪৮ হাজারের বেশি কনটেইনার জমে আছে। সাম্প্রতিক সময়ে এটি সর্বোচ্চ রেকর্ডকৃত সংখ্যা। গত ১৭ আগস্ট বন্দরে কনটেইনারের সংখ্যা ৪৯ হাজার ১৩১ টিইইউএসে পৌঁছে যায়, যা ধারণক্ষমতার সীমা অতিক্রমের কাছাকাছি।

বন্দরের মোট ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউএস হলেও ক্রেন, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লরির চলাচলের সুবিধার্থে প্রায় ৩০ শতাংশ জায়গা খালি রাখা জরুরি। তাই বাস্তবে ধারণক্ষমতা অনেক কমে আসে। স্বাভাবিক সময়ে বন্দরে ৩৭-৩৮ হাজার কনটেইনার থাকলেও বর্তমানে তা অনেক বেশি।


জাহাজ বার্থিং নীতি ও জটের কারণ

আগে বন্দর একসঙ্গে সর্বোচ্চ ১০টি কনটেইনারবাহী জাহাজকে বার্থিং দিত। ফলে একটি জাহাজ আনলোড করতে গড়ে ৪-৫ দিন সময় লাগত। কিন্তু দীর্ঘ অপেক্ষা ও সমালোচনার মুখে এখন একসঙ্গে ১৩টি জাহাজ বার্থিংয়ের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এর ফলে বহির্নোঙরে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমে ২ দিনে নেমে এসেছে।

তবে একইসঙ্গে এত জাহাজ আনলোড করার কারণে বন্দরে কনটেইনার চাপ বেড়ে নতুন জট তৈরি হয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, নিলামযোগ্য ১০ হাজারের বেশি কনটেইনার ও আইসিডিগামী ২ হাজার কনটেইনারের কারণে চাপ আরও তীব্র হয়েছে।


এনবিআরের কঠোর নির্দেশনা

কনটেইনার জট নিয়ন্ত্রণে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) নতুন নির্দেশনা দিয়েছে।

  • জাহাজ থেকে যেদিন কনটেইনার নামবে, সেদিনই তা অফডকে সরিয়ে নিতে হবে
  • আগের নিয়ম অনুযায়ী, আমদানিকারকেরা চার দিন পর্যন্ত শুল্ক ছাড়া বন্দরের ইয়ার্ডে কনটেইনার রাখতে পারতেন। এই সুবিধা ব্যবহারের কারণে ইয়ার্ডে কনটেইনার জমে যেত।
  • নতুন নিয়মে আমদানিকারকদের প্রথম বা দ্বিতীয় দিনের মধ্যেই কনটেইনার অফডকে নিতে হবে।
  • বিশেষ পরিস্থিতিতে কাস্টমস কমিশনার ডুয়েল ডেলিভারির অনুমতি দিতে পারবেন।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের জয়েন্ট কমিশনার মোহাম্মদ মারুফুর রহমান বলেন, “কনটেইনার জট নিরসনে নতুন নির্দেশনা কার্যকর হলে বন্দরের চাপ কমবে। তবে অফডকের সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।”


অফডকের ভূমিকা ও চ্যালেঞ্জ

বর্তমানে ২১টি বেসরকারি অফডক (ICD – Inland Container Depot) চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে কাজ করছে। এখানেই আমদানিকৃত পণ্যের ডেলিভারি এবং তৈরি পোশাক রপ্তানির জাহাজীকরণ সম্পন্ন হয়।

অফডকগুলোতে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি এবং রাস্তার যানজট নিরসন একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমএসসি শিপিংয়ের হেড অব অপারেশন আজমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বন্দর থেকে কনটেইনার সরানোই সমাধান নয়; অফডকের সক্ষমতা ও রাস্তাঘাটের অবস্থা বিবেচনায় নিতে হবে।”


বহির্নোঙরে খালাসযোগ্য পণ্য ও সীমাবদ্ধতা

গম, সিমেন্ট ক্লিংকার, কয়লা ও স্ক্র্যাপ লোহার মতো বাল্কপণ্য বহির্নোঙরে খালাস করা সম্ভব। কিন্তু আমদানি ও রপ্তানির কনটেইনার অবশ্যই বন্দরের এনসিটি, সিসিটি ও জিসিবি বার্থে আনলোড করতে হয়। ফলে কনটেইনার নির্ভর কার্যক্রমে চাপ বেড়ে যায়।


ভবিষ্যৎ করণীয়

বন্দর ব্যবহারকারীরা মনে করছেন, চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট নিরসনে শুধু কঠোর নির্দেশনা নয়, বরং একটি সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন।

  • অফডকের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • বন্দর থেকে অফডকের সড়কপথে যানজট নিরসন জরুরি।
  • নিলামযোগ্য কনটেইনার দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত।
  • আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কনটেইনার ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু করা দরকার।

যদি এসব পদক্ষেপ নেয়া যায়, তাহলে চট্টগ্রাম বন্দর আরও দক্ষ ও গতিশীলভাবে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবে।


উপসংহার

চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু। এখানে কনটেইনার জট শুধু আমদানি-রপ্তানির গতি শ্লথ করে না, বরং আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দেশের ভাবমূর্তিতেও প্রভাব ফেলে। এনবিআরের নির্দেশনা একটি জরুরি উদ্যোগ হলেও দীর্ঘমেয়াদে বন্দর ও অফডকের সক্ষমতা বৃদ্ধিই হবে স্থায়ী সমাধান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *